কিছু মানুষের ধারণা ইসলামি রাষ্ট্র গঠনই যেহেতু মূল লক্ষ্য, বিধায় যে পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক না কেন, তা শরিয়া অনুমোদিত ও জায়েজ হয়ে যাবে। আর এর জন্য তারা বেছে নিয়েছে গণতন্ত্র নামক কুফরি তন্ত্রের মতো ইমানবিধ্বংসী এক পথ। মূলত শত্রুদের দেখানো পথে যে কখনো গন্তব্যে পৌঁছা যায় না; এ সহজ নীতিটিও আজ অনেকে বুঝতে চায় না। এমন সরল ও স্বীকৃত একটি বিষয়ও যাদের বুঝে আসে না, তারা কীভাবে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করার সাহস দেখায়?! আজকের আলোচনায় এ দিকটি স্পষ্ট করব, কেন গণতন্ত্র দিয়ে কখনোই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আশা করি, পুরো প্রবন্ধটি পড়লে সবটুকু না হলেও অনেকটাই ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমরা আপাতত পনেরোটি কারণ উল্লেখ করছি, যা প্রমাণ করবে যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
প্রথম কারণ :
কুফর-শিরক মিটিয়ে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার পর ইসলামি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে নামাজ কায়েম করা। এ কাজ না করলে হাদিসে শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অনুমতিও আছে। মহান আল্লাহ বলেন :
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ.
অর্থাৎ আমি তাদেরকে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে, সৎকর্মের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। (সুরা হজ : ৪১)
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ، قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ؟ فَقَالَ: لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ.
অর্থাৎ আউফ বিন মালিক র. সূত্রে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম নেতা তারাই, যাদের তোমরা ভালোবাসো আর তারাও তোমাদের ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য দুআ করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দুআ করো। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট নেতা তারা, যাদের তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, তোমরা তাদের অভিসম্পাত করো এবং তারাও তোমাদের অভিসম্পাত করে। রাসুলুল্লাহ সা.-কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা কি তলোয়ার দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করব না? উত্তরে নবি কারিম সা. বললেন, না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখে ততক্ষণ পর্যন্ত নয়। (সহিহ মুসলিম: ৩/১৪৮১, হা. নং ১৮৫৫, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত)
নামাজ কায়েমের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তব্য কী? এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মত হলো, বেনামাজীকে তাওবা না করা পর্যন্ত জেলে বন্দি রাখা হবে। আর অন্য ফকিহদের মত হলো তাকে তাওবার আহবান জানানো হবে; অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে।
আল-মওসুআতুল ফিকহিয়্যাতে এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের মতামত এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :
لاَ خِلاَفَ فِي أَنَّ مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ جَاحِدًا لَهَا يَكُونُ مُرْتَدًّا، وَكَذَا الزَّكَاةُ وَالصَّوْمُ وَالْحَجُّ؛ لأِنَّهَا مِنَ الْمُجْمَعِ عَلَيْهِ الْمَعْلُومِ مِنَ الدِّينِ بِالضَّرُورَةِ. وَأَمَّا تَارِكُ الصَّلاَةِ كَسَلاً فَفِي حُكْمِهِ ثَلاَثَةُ أَقْوَالٍ: أَحَدُهَا: يُقْتَل رِدَّةً، وَهِيَ رِوَايَةٌ عَنْ أَحْمَدَ وَقَوْل سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، وَعَامِرٍ الشَّعْبِيِّ، وَإِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، وَأَبِي عَمْرٍو، وَالأْوْزَاعِيِّ، وَأَيُّوبَ السَّخْتِيَانِيِّ، وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْمُبَارَكِ، وَإِسْحَاقَ بْنِ رَاهَوَيْهِ، وَعَبْدِ الْمَلِكِ بْنِ حَبِيبٍ مِنَ الْمَالِكِيَّةِ، وَهُوَ أَحَدُ الْوَجْهَيْنِ مِنْ مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ، وَحَكَاهُ الطَّحَاوِيُّ عَنِ الشَّافِعِيِّ نَفْسِهِ، وَحَكَاهُ أَبُو مُحَمَّدِ بْنُ حَزْمٍ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، وَمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، وَعَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ، وَأَبِي هُرَيْرَةَ، وَغَيْرِهِمْ مِنَ الصَّحَابَةِ. وَالْقَوْل الثَّانِي: يُقْتَل حَدًّا لاَ كُفْرًا، وَهُوَ قَوْل مَالِكٍ وَالشَّافِعِيِّ، وَهِيَ رِوَايَةٌ عَنْ أَحْمَدَ. وَالْقَوْل الثَّالِثُ: أَنَّ مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ كَسَلاً يَكُونُ فَاسِقًا وَيُحْبَسُ حَتَّى يُصَلِّيَ، وَهُوَ الْمَذْهَبُ عِنْدَ الْحَنَفِيَّةِ.
অর্থাৎ এত কারো মতানৈক্য নেই যে, যে ব্যক্তি নামাজ অস্বীকার করে ছেড়ে দিবে সে মুরতাদ (ইসলামত্যাগী) হয়ে যাবে। অনুরূপ জাকাত, রোজা ও হজেরও একই বিধান। কেননা, এগুলো সর্বসম্মতভাবে ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ ও জ্ঞাত আবশ্যকীয় বিধান। তবে অলসতাবশত নামাজ পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়। প্রথম মত হলো, তাকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে। এটা ইমাম আহমাদ রহ.-এর একটি উক্তি। এছাড়াও সাইদ বিন জুবাইর রহ., ইমাম শাবি রহ.,ইমাম ইবরাহিম নাখয়ি রহ., ইমাম আবু আমর রহ., ইমাম আওজায়ি রহ., ইমাম আইয়ুব সাখতিয়ানি রহ., ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ., ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াহ রহ. ও ইমাম আব্দুল মালিক বিন হাবিব মালিকি রহ.; এদের মতও এরূপই। শাফিয়ি মাজহাবের দুটি মত হতে একটি মত এমনই। ইমাম তাহাবি রহ. তো স্বয়ং ইমাম শাফেয়ি রহ. থেকেই এ মতটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে হাজম রহ. এ মতটি হজরত উমর র., মুআজ বিন জাবাল র., আব্দুর রহমান বিন আঊফ র., আবু হুরাইরা র.-সহ প্রমূখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় মত হলো, তাকে হত্যা করা হবে হদ তথা দণ্ডবিধি হিসাবে, মুরতাদ হিসাবে নয়। এটা ইমাম মালিক রহ. ও ইমাম শাফিয়ি রহ. এর মাজহাব। ইমাম আহমাদ রহ. এর একটি উক্তিও এমনই। তৃতীয় মত হলো, যে ব্যক্তি অলসতাবশত নামাজ ছেড়ে দিবে সে ফাসিক বলে বিবেচিত হবে। নামাজ পড়ার আগ পর্যন্ত তাকে বন্দি করে রাখা হবে। আর এটাই হানাফিদের মাজহাব। (আল-মওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২২/১৮৭, অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)
এখন ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ গণতন্ত্র কতোটুকু সফল হবে? ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মাত্র ২% মানুষ নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। তাহলে আপনি কি করে আশা করেন যে, তারা নামাজ কায়েমের এ ধরনের বিধানের পক্ষে ভোট দেবে?! আর তাদের ভোটে ইসলামি বিধান বাস্তবায়িত হবে?! এটা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র।
বস্তুত গণতন্ত্রবাদী কোনো একটি ইসলামি দল যদি ভাগ্যক্রমে ক্ষমতায় চলেও আসে তবুও তারা কখনোই ইসলামি বিধানানুসারে নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে না। কেননা, এতে পরের নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির আশংকা আছে।
এ বিষয়টি আরও একটু পরিষ্কার করে বলি। যদি কোনো রাষ্ট্রের শতভাগ মুসলিম নামাজ পড়ে তবুও আমরা ঐ রাষ্ট্রকে ইসলামি রাষ্ট্র বলব না, যদি না সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বেনামাজির শাস্তির বিধান থাকে। কিন্তু যে রাষ্ট্রে বেনামাজির শাস্তির বিধান আছে, চাই সে রাষ্ট্রের সবাই নামাজ নাও পড়ুক, তবুও সেটা ইসলামি রাষ্ট্র। বস্তুত ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেই এই বিভ্রান্তিগুলো ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ তো এমনটিও মনে করে যে, তাদের দল পার্লামেন্টের ১৫১টি আসন পেলেই বুঝি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে!!!
দ্বিতীয় কারণ :
ইসলাম নামক মুক্তির বিহঙ্গ আজ জাতীয়তাবাদ নামক লোহার খাঁচায় বন্দী। মুসলিমদের সীসাঢালা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আজ আমেরিকা, ব্রিটেনের এঁকে দেওয়া সীমারেখায় কেঁদে কেঁদে মরছে। গণতন্ত্র কি পারবে এ লোহার খাঁচা ভেঙে উম্মাহকে পুনরায় ঐক্য আর মুক্তির স্বাদ দিতে? শত্রুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে, তাদেরই শেখানো বুলি আওড়িয়ে শত্রু বধের কৌশলের কথা শুনলে তো পাগলেও হাসবে।
তৃতীয় কারণ :
কোনো ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম থেকে ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে গেলে কিংবা নাস্তিক হয়ে গেলে ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, তাকে তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসার আহবান জানানো। এতে সে অসম্মতি প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো, তাকে হত্যা করা।
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ ابْن عَبَّاسٍ فَقَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো। (সহিহ বুখারি : ৪/৬১, হা. নং ৩০১৭, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
ইমাম তিরমিজি রহ. স্বীয় সুনানে উক্ত হাদিসটি বর্ণনা শেষে লিখেছেন :
وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ فِي الْمُرْتَدِّ، وَاخْتَلَفُوا فِي الْمَرْأَةِ إِذَا ارْتَدَّتْ عَنِ الإِسْلاَمِ، فَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ العِلْمِ: تُقْتَلُ، وَهُوَ قَوْلُ الأَوْزَاعِيِّ، وَأَحْمَدَ، وَإِسْحَاقَ. وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ: تُحْبَسُ وَلاَ تُقْتَلُ، وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، وَغَيْرِهِ مِنْ أَهْلِ الكُوفَةِ.
অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে আহলে ইলমের নিকট এটাই অনুসৃত বিধান। তবে কোনো নারী ইসলাম ত্যাগ করলে তার বিধানের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরাম মতানৈক্য করেছেন। একদল উলামায়ে কিরামের মতে (পুরুষ মুরতাদের মতো) তাকেও হত্যা করা হবে। এটা ইমাম আওজায়ি রহ., ইমাম আহমাদ রহ. ও ইমাম ইসহাক রহ.-এর মত। আর অন্য আরেক দল উলামায়ে কিরাম বলেন, তাকে বন্দি করে রাখা হবে, হত্যা করা যাবে না। এটা ইমাম সুফইয়ান সাওরি রহ. ও কুফার অনেক ফুকাহায়ে রামের মত। (সুনানে তিরমিজি : ৩/১১১, হা. নং ১৪৫৮ সংশ্লিষ্ট আলোচনা প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
আপনার কী মনে হয়, যারা ইসলাম ধ্বংস করার জন্য বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিচালনা করছে, কোটি কোটি ডলার খরচ করছে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য, তারা এত সহজে আপনাকে এই আইন বাস্তবায়ন করতে দিবে?
চতুর্থ কারণ :
ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদি-খ্রিস্টানদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করা। ইমাম ইবনুল কাইয়িম জাওজিয়া রহ. বলেন :
قَالَ الْمُخَصِّصُونَ بِالْجِزْيَةِ لِأَهْلِ الْكِتَابِ: الْمُرَادُ مِنْ إِرْسَالِ الرُّسُلِ وَإِنْزَالِ الْكُتُبِ إِعْدَامُ الْكُفْرِ وَالشِّرْكِ مِنَ الْأَرْضِ وَأَنْ يَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ كَمَا قَالَ تَعَالَى: {وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ} [البقرة: 193] ، وَفِي الْآيَةِ الْأُخْرَى: {وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ} [الأنفال: 39] ، وَمُقْتَضَى هَذَا أَلَّا يُقَرَّ كَافِرٌ عَلَى كُفْرِهِ، وَلَكِنْ جَاءَ النَّصُّ بِإِقْرَارِ أَهْلِ الْكِتَابِ إِذَا أَعْطَوُا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ، فَاقْتَصَرْنَا بِهَا عَلَيْهِمْ وَأَخَذْنَا فِي عُمُومِ الْكُفَّارِ بِالنُّصُوصِ الدَّالَّةِ عَلَى قِتَالِهِمْ إِلَى أَنْ يَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.
অর্থাৎ জিজিয়া শুধু ইহুদি-খ্রিস্টানদের জন্যই প্রযোজ্যকারী ফুকাহায়ে কিরাম বলেন, আমবিয়া কিরামকে প্রেরণ ও কিতাবসমূহের অবতরণের উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবী থেকে কুফর ও শিরক একেবারে নিশ্চিহ্ন করা এবং একমাত্র আল্লাহর দ্বীনই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।’ [সুরা বাকারা : ১৯৩] অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।’ [সুরা আনফাল : ৩৯] এ আয়াতের দাবি হলো, কোনো কাফিরকেই তার কুফরির উপর থাকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু অন্য আয়াতে আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিস্টানরা অবনত মস্তকে বশ্যতা স্বীকার করে জিজিয়া দিলে সেক্ষেত্রে তাদেরকে অব্যহতি দেওয়ার কথা এসেছে। অতএব, আমরা শুধু তাদের ব্যাপারেই ক্ষান্ত থাকব। আর অন্যান্য কাফেরদের ব্যাপারে ঐ আয়াত গ্রহণ করব, যেখানে সামগ্রিকভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। (আহকামু আহলিজ জিম্মা : ১/৯৫, প্রকাশনী : রামাদি, দাম্মাম)
অতএব, যারা ঠুনকো কারণে-অকারণে মার্কিন, চিন বা ভারতীয় দূতাবাসে ধরনা দেয়, তারা এ জিজিয়া ব্যবস্থা চালু করার সাহস দেখাবে বলে আপনার মনে হয়? কুফফারদের ফর্মুলা অনুসরণ করে তাদের স্বার্থবিরোধী আইনের স্বপ্ন দেখা কি নিছক বিভ্রান্তি নয়?
পঞ্চম কারণ :
ইসলামি রাষ্ট্র ইসলাম বিরোধী সকল প্রকার বাতিল মতবাদ, মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্র ও দলকে নিষিদ্ধ করছে; চাই তারা বামপন্থী হোক, সেক্যুলার হোক, কিংবা জাতীয়তাবাদী হোক। তাদেরকে তাওবা করার আহবান জানানো হবে। তাওবা করলে তারা মুক্ত; অন্যথায় তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করে হত্যা করা হবে।
শুধু তাই নয়, ইসলামি শরিয়ায় ‘সরকারি দল’ এবং ‘বিরোধী দল’ এসব পরিভাষা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য। ইসলামে সকল প্রকার দলাদলি নিষিদ্ধ। এক আমিরের নেতৃত্বে গোটা উম্মাহ পরিচালিত হবে। এটাই হলো ইসলামি ব্যবস্থা। বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকার করে নিয়ে এ কাজ করার সুযোগ কোথায়?
জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে তাদেরই প্রিয় নাস্তিক বুদ্ধিজীবী, ইসলামবিরোধী কবি-সাহিত্যিককে হত্যা করার নৈতিক শক্তি একটি ইসলামি দল কোথায় পাবে? রাজনৈতিক দলসমূহকে নিষিদ্ধ করতে গেলে কার্যত গণতন্ত্রকেই কবর চাপা দিতে হবে। যে জনগণের কাছ থেকে ভোটভিক্ষার মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় এসেছে তারা এটা মানবে কেন? ঐ সমস্ত দল বা তাদের সাপোর্টাররাই বা বসে থাকবে কেন? আর পশ্চিমারাই বা বসে বসে আঙুল চুষবে কেন?
ষষ্ঠ কারণ :
একটি ইসলামি রাষ্ট্র সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, যত্রতত্র বেপর্দা চলাফেরা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সহশিক্ষা, অশ্লীল নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা নিষিদ্ধ করবে। সিনেমা হল, নাইটক্লাব, মদের বার, ডিজে পার্টি, নিষিদ্ধ গানের আসর বন্ধ করবে। সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলবে। ইসলামি মূল্যবোধ বিরোধী পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ব্লগ, সাময়িকী, বইপত্র, কবিতা, উপন্যাস, সাহিত্য নিষিদ্ধ করবে। বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম (প্রস্তরাঘাত করে হত্যা) করবে। সমকামীদের দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি বা প্রয়োজনবোধে হত্যা করবে। চারুকলা-কারুকলার নামে নিষিদ্ধ মূর্তি-ভাস্কর্য তৈরির চর্চা বন্ধ করবে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকারের এসব করার সুযোগ কোথায়?
আপনি যদি ক্ষমতায় যেতে চান তাহলে আপনাকে জনপ্রিয়তা খুঁজতে হবে। আর আপনি যদি জনপ্রিয়তা খুঁজতে চান, তাহলে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা আপনার নিজের মাঝেই ইসলাম থাকবে না। আসলে জনপ্রিয়তার রাজনীতিই আজকের ইসলামি দলসমূহের আদর্শিক অধঃপতনের প্রধান কারণ।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন :
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ.
অর্থাৎ আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। তারা শুধু নিছক ধারণা ও অনুমানের অনুসরণ করে। তারা তো ধারণা ও অনুমান ছাড়া কিছুই করছে না। (সুরা আনআম : ১১৬)
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন :
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ- وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا.
অর্থাৎ যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং তুমি মানুষকে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবে। (সুরা নাসর : ১-২)
কাজেই ইসলামের বিজয় আসলে মানুষ এমনিতেই দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে। কিন্তু গণতন্ত্রী ভাইয়েরা উল্টো বুঝে মনে করেন, আগে মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে, তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সূত্রে তারা ইসলামের বিজয় ঘটাবেন।
সপ্তম কারণ :
সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা উৎখাত করতে গেলে এবং জাকাত ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করতে গেলে দেশের ভোগবাদী ধনিশ্রেণি আপনাকে অপসারণ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। কেননা, এই সুদের জোরেই তারা জিইয়ে রেখেছে তাদের আদিগন্ত ভোগলিপ্সা, শাসন, শোষণ, অবৈধ কর্তৃত্ব আর সম্পদের বিশাল পাহাড়। আর একথা তো সর্বজনবিদিত যে, এই ব্যবসায়ী গ্রুপই বর্তমান পুঁজিবাদ নির্ভর গণতন্ত্রের পেছনের কলকাঠি নাড়ে। প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক র.-এর যুগেও একটা গ্রুপ জাকাত না দেওয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। তাহলে তো বর্তমান যুগের পুঁজিবাদীদের কথা বলাই বাহুল্য।
অষ্টম কারণ :
মিশর কিংবা আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দরকার পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। গণতন্ত্রবাদীদের এসব পরিস্থিত সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি কতটুকু? তাদের প্রস্তুতি তো কেবল পোস্টারিং আর দেয়াল লিখন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বরং তারা এ ধরনের প্রস্তুতিকে অসাংবিধানিক ও অনিয়মতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ আলিমদের পরিষ্কার মত হলো, সার্বক্ষণিক জিহাদের প্রস্তুতি মুসলিমদের জন্য ফরজ; চাই যুদ্ধের পরিস্থিতি থাকুক আর নাই থাকুক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন :
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ.
অর্থাৎ তোমরা কাফেরদের মোকাবেলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। (সুরা আনফাল : ৬০)
তিনি আরো বলেন :
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُم مَّيْلَةً وَاحِدَةً.
অর্থাৎ কাফিররা কামনা করে, যেন তোমরা অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাব সম্পর্কে অসতর্ক ও উদাসীন হও। যাতে তারা তোমাদের উপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। (সুরা নিসা : ১০২)
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: سَتُفْتَحُ عَلَيْكُمْ أَرَضُونَ، وَيَكْفِيكُمُ اللهُ، فَلَا يَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَلْهُوَ بِأَسْهُمِهِ.
অর্থাৎ উকবা বিন আমের র. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের হাতে সত্ত্বরই অনেক রাষ্ট্র বিজিত হবে এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যথেষ্ঠ হবে। এতদসত্বেও তোমাদের কেউ যেন তিরন্দাজি ভুলে না বসে। (সহিহ মুসলিম : ৩/১৫২২, হা. নং ১৯১৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত)
মূলত গণতন্ত্র হলো কাফেরদের তৈরি একটি ফাঁদ। যখন তারা দেখবে, একটি ইসলামি দল ক্ষমতায় চলে এসেছে তখন তারা মিথ্যা অভিযোগে তাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালাবে এবং তখনও তারা গণতন্ত্র রক্ষারই অজুহাত দেবে। ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ আছে।
গনতন্ত্র নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন :
‘গনতন্ত্র এমন একটা ধর্ম, যা তার অনুসারীদের বেঁধে দেয়। এমনকি বুলেটের আঘাতে তোমাদের বুক ঝাঁঝরা করে দিলেও তোমরা সর্বোচ্চ রাস্তায় গিয়ে একটু প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। আর এতটুকু করতে পারলেই তারা এই ভেবে পরিতৃপ্ত হয়ে যায় যে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় হয়ে গিয়েছে!’
নবম কারণ :
আমেরিকার র্যাইন্ড ইনস্টিটিউশন মডারেট মুসলিমদের যে চারটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে এবং যেগুলো তারা আমাদের উপর আরোপ করতে চায় তার দুটি হলো :
ক. গণতন্ত্রকে সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে যেভাবে পশ্চিমা ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয়। (ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি মতে নয়)
খ. ধর্মনিরপেক্ষ আইনের উৎস গ্রহণ করা। যারা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রন্থের আইন চায় তারা মূলত চরমপন্থী।
বিস্তারিত জানার জন্য ইমাম আনওয়ার আওলাকি রহ.-এর Accepting Democracy as understood in the liberal western traditions লেকচারটি শুনতে পারেন।
আপনি হয়ত ভাবছেন, গণতন্ত্র গ্রহণ করলেই পশ্চিমারা আপনার উপর খুশি হয়ে যাবে, মুসলিম ঘোষণা করবে। ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে, সেই গণতন্ত্র নয়, যে গণতন্ত্র আপনি বুঝেন বা যে গণতন্ত্র আপনি পালন করতে চান; বরং তাদের বক্তব্য একেবারে Accepting Democracy as understood in the liberal western traditions
তারা গনতন্ত্রবাদী ইসলামি দল ইস্যুতে বলেছে-
as in the case of present Egyptian Muslim Brotherhood is not Enough.
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, র্যা ন্ড ইন্স্টিটিউশনের সংজ্ঞায় যেটা মডারেট ইসলাম, আমাদের কাছে তা পরিষ্কার কুফর।
এ বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাদের অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন :
وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ.
অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টানরা কখনোই তোমার ওপর সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের দ্বীনের অনুসরণ করবে। (সুরা বাকারা : ১২০)
দশম কারণ :
প্রতিপক্ষের ওপর বিজয়ী হবার সবচে সহজ কৌশল হলো, Divide & Rule অর্থাৎ বিভেদ সৃষ্টি করো এবং শাসনকার্য পরিচালনা করো। মোটাদাগে দেখলে এ দেশের অল্প কিছু মানুষই ইসলামপন্থী। অতঃপর বহুদলীয় গণতন্ত্রের ফর্মুলায় এই অল্প সংখ্যক ভোট ভাগ হবে এত এত বিচ্ছিন্ন ইসলামি দলগুলোর মাঝে। একদলের শাইখুল হাদিস দাঁড়াবে আর অপরদলের দাড়িবিহীন শিক্ষিত তরুণ হবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। অতঃপর সমর্থকদের মাঝে শুরু হবে নোংরা কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি, গিবত, অপবাদ আর পরনিন্দার বৃষ্টিধারা। দূর থেকে সেক্যুলার-বামপন্থীরা মজা লুটবে। আসলে গণতন্ত্র আর নির্বাচন এই উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্যের বিষফোঁড়া রোপণ করে দিয়েছে, যার ফল আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে বর্তমানে ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ঠিক কতটি, তা এই মূহুর্তে বলা মুশকিল। তবে এর ভঙ্গুরতা এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, এদেশে ইসলামি ঐক্যজোটের সংখ্যাই চার থেকে পাঁচটি!!
একাদশ কারণ :
বর্তমানে নির্বাচনে বিদেশী প্রভাব একটি ওপেন সিক্রেট। প্রতিটি ইলেকশনের পূর্বে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের ভারত আর ওয়াশিংটনমুখী দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য তাই খুবই কমন। বলা যায়, দিল্লী-ওয়াশিংটন থেকেই নির্ধারন করা হয়ে থাকে আগামী পাঁচ বছর কারা এদেশে তাদের প্রক্সি দালাল হিসেবে কাজ করবে। তার ওপরে ভোটে কারচুপি, জাল ভোটপ্রদান, ব্যালট বক্স ছিনতাই, দূর্নীতি, নির্বাচন কমিশনের অবৈধ হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার; এগুলো তো আছেই। এই সিরিয়ালে সর্বশেষ সংযোজন হলো, এক তরফা প্রহসনের নির্বাচন। ইসলামি দল তো দূরের কথা, সেক্যুলার দলগুলোরও এক্ষেত্রে কিছুই করার ছিল না।
আর গণতন্ত্রের তথাকথিত ‘সর্বশক্তির উৎস’ বলে পরিচত ‘জনগন’ তো এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করে না; এমনকি দুয়েকটি ফাঁকা বুলিও নয়। আসলে সাধারণ জনতার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। ‘চাচা তোর আপন প্রাণ বাঁচা’ নিয়েই সবাই ব্যস্ত। দেশের মানুষ প্রহসনের নির্বাচনের আগেও যেমন সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমোতে যেত, এখনও তেমনই যায়। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বারবার ওয়াশিংটনের দিকে হাত তুলে মুনাজাত করেছিল, কিন্তু ওয়াশিংটন আকার ইঙ্গিতে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মুখে যাই বলি না কেন, কাজে আমরা তার পক্ষই নিব, যারা আমাদের বেশি সুবিধা দিবে আর বেশি গোলামি করবে। সেক্যুলারদের প্রভু ওয়াশিংটনের এই নীতিটি আপনি আরও ভালো করে বুঝবেন গণতন্ত্রের পুরোপুরি বিপরীত রাজতন্ত্রবাদী সৌদিদের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক থেকে। আসলে তাদের দরকার কর্তৃত্ব আর আধিপত্যি; গণতন্ত্রের মন্ত্র তো ওরা জপে কেবল মুসলিম উম্মাহ ও তৃতীয় বিশ্বের লোকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যে।
পশ্চিমা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো সাম্রাজ্যবাদ নীতি। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আক্রমন করা, মুসলিম নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা, শিশুদের রক্ত ঝরানো, মূল্যবান খনিজ সম্পদ লুটে নেওয়া; এগুলো পশ্চিমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। এজন্য তারা কখনোই কোনো দেশে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না, যারা তাদের দখলদারিত্বের বিরোধিতা করবে আর নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য জিহাদ পরিচালনা করবে। অথচ এ ব্যাপারে আলিমদের ইজমা হলো, যখন কাফিররা কোনো মুসলিম দেশে আক্রমন করে তখন ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সারা বিশ্বের মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না-
ক. দ্বীন ইসলামের চিরশত্রু ইহুদি-খ্রিস্টানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক ক্রুসেড যুদ্ধ চালিয়েছে, মুসলিমদের প্রথম কিবলা বাইতুল মাকদিস দখল করে রেখেছে, স্পেন থেকে ইসলামের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে দিয়েছে।
খ. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া মিলে মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তির কেন্দ্র খিলাফতকে ধ্বংস করেছে, মধ্যপ্রাচ্যকে ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। কামাল আতার্তুর্ক নামক গাদ্দারের মাধ্যমে পশ্চিমারা সে সময় কার্যত তুরস্কে ইসলামকেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।
১৯২৪ সালের ২৪ জুলাই লুজেন চুক্তি (Lausanne Treaty) স্বাক্ষর হওয়ার পর হাউস অফ কমন্সে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড কার্জন ঘোষণা দিয়েছিল যে, মূল বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এটি আর কোনোদিনও মাথা তুলে দাঁড়াবে না। কারণ, আমরা তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তা হলো খিলাফত এবং ইসলাম।’ অনুরূপ বাইতুল মাকদিসে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ জেনারেল অ্যালেনবি ঘোষণা করেছিল, ‘আজ ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটল।’
আর দামেস্ক দখল করে নেওয়ার পর ফরাসি জেনারেল গরো ((Gourou) তড়িৎগতিতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ.-এর সমাধিস্থলে প্রবেশ করে তার কবরে লাথি মেরে বলেছিল, ওঠো সালাহউদ্দিন, আমরা আবার ফিরে এসেছি।’ বস্তুত খিলাফত ধ্বংসের পর পশ্চিমাদের উল্লাসের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।
গ. ইসলামি হুকুমত কায়েমের চেষ্টার জন্যে এবং মুজাহিদদের সাহায্য করার জন্য এরাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে হত্যা করেছিল।
ঘ. এরাই সৌদি বাদশাহ ফয়সালকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছে। বাদশাহ ফয়সালের অপরাধ ছিলো, তিনি আমেরিকার মিত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, মুসলিমদের প্রথম কিবলা বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন এবং পশ্চিমাদের কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ঙ. মুসলিমদের পবিত্র ভূমিতে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলে ইমাম হাসান আল বান্না রহ. যখন দেখলেন, তাঁর চোখের সামনে ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করা হচ্ছে, তাই তিনি দশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে চাইলেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার তিন রাষ্ট্রদূত বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্তপত্র মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। এর দুই মাস পর মিশরের রাজা ফারুকের সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মাহমুদ আব্দুল মাজিদ শহরের সবচেয়ে বড় রাস্তায় ইমাম হাসান আল বান্না রহ.-কে হত্যার চেষ্টা করে। এতে তিনি আহত হন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিলো। তখন রাজা ফারুকের আরেক ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মুহাম্মাদ ওয়াসফি পুনরায় ইমাম হাসান আল বান্না রহ.-কে গুলি করে শহিদ করে দেয়।
দ্বাদশ কারণ :
আধুনিক কালে নির্বাচন মানেই লক্ষ লক্ষ টাকার ছড়াছড়ি। মিছিল, মিটিং, মাইকিং, পোস্টারিং ইত্যাদিতে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সবসময় তারই প্রতিযোগিতা চলে। একগাদা ভাড়া করা ক্যানভাসার যোগাড় করা হয়। কোথাও কোথাও তো অসভ্য নর্তকী আর গায়িকাদেরও ভাড়া করা হয়। এসব ক্যানভাসারদের কাজই হলো, জোর গলায় নিজ নেতার চরিত্রকে ‘ফুলের মতো পবিত্র‘ বলে দাবি করা আর যে কোনোভাবে প্রতিপক্ষের নামে দুর্নাম ও কুৎসা রটনা করা। একগাদা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সুযোগ পেলে আকাশের চাঁদ হাতে এনে দেওয়ার গল্পও ছাড়া হয়।
ভোটারদের মনোরঞ্জনের জন্য ক্ষণেক্ষণে পান, তামাক, চা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা, মদ, গাঁজা পরিবেশন করা হয়। এমনকি প্রয়োজনে নগদ টাকা-পয়সা দিয়ে ভোট কেনা হয়। যে এই কাজ যত বেশি করতে পারবে সে তত বেশি সফল। একজন ইসলামপন্থী না নিজের মিথ্যা গুণগান গাওয়ার জন্য লোক ভাড়া করতে পারে, না অন্যের নামে মিথ্যা বদনাম রটনা করতে পারে, না মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, না তরুণদের হাতে মদের বোতল আর বৃদ্ধদের হাতে হুক্কার ডিব্বা ধরিয়ে দিতে পারে, না সে দূর্নীতিবাজদের মতো ক্যানভাসে লাখ লাখ টাকা অপচয় করতে পারে, না সে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ভোট কেনার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে। এসব যদি সে না-ই পারে তাহলে এই প্রতিযোগিতায় তার কোনো স্থান নেই। কেননা, তথাকথিত নীতি-নৈতিকতার বুলি তো কত আগেই নগদ টাকা-পয়সা আর বিড়ি সিগারেটের গন্ধে কর্পুরের মতো উবে গেছে। আর যদি সে এগুলোও করতে পারে তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে ইসলামি চরিত্রের আর ছিঁটেফোঁটাও বাকি নেই। জনপ্রিয়তা অর্জনের স্রোতে গা ভাসিয়ে সব ধুয়েমুছে একেবারে সাফ হয়ে গেছে।
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا وَرَجُلاَنِ مِنْ قَوْمِي، فَقَالَ أَحَدُ الرَّجُلَيْنِ: أَمِّرْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَقَالَ الآخَرُ مِثْلَهُ، فَقَالَ: إِنَّا لاَ نُوَلِّي هَذَا مَنْ سَأَلَهُ، وَلاَ مَنْ حَرَصَ عَلَيْهِ.
আবু মুসা র. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং দুজন লোক রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট আসলাম। তাদের একজন বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদেরকে গভর্নর বানিয়ে দিন। দ্বিতীয়জনও অনুরূপ বলল। তখন তিনি বললেন, আমরা এরূপ ব্যক্তিকে কোনো পদে মনোনীত করি না, যে তার প্রার্থী হয় এবং পদের প্রতি লালায়িত হয়। (সহিহ বুখারি : ৯/৬৪, হা. নং ৭১৪৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
ত্রিয়োদশ কারণ :
গণতন্ত্রের মাধ্যমে একটা ইসলামি দল যদি ক্ষমতায় আসেও (বাংলাদেশে সে আশা করা নিতান্তই গুড়েবালি) তাহলেও তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ইতিহাস ও সমীকরণ এটাই বলে। একবার যদি পারেও এর পরের ইলেকশনে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সবচেয়ে ভালো শাসনেও জনগণের মাঝে ‘নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতে সর্বসুখ আমার এ বিশ্বাস’—টাইপের অনুভূতি কাজ করতে পারে। ফলে আবারও দেশ পরিচালিত হবে কুফরি আদর্শ ও মূলনীতিতে। এভাবে পাঁচ বছর ইসলাম আর পাঁচ বছর কুফর- এই অবস্থা তো আমাদের আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে তৎকালীন কাফিরদের সেই প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দেয় যে, ‘আপনি এক বছর আমাদের ইলাহগুলোর ইবাদত করুর, আমরাও পরের বছর আপনার রবের ইবাদত করব।’
চতুর্দশ কারণ :
প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি, আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ স. পৃথিবীতে ব্যাপক বিস্তৃত একটি খিলাফতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা প্রতিটি মাটির ঘর বা তাঁবু পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণ বা জিজিয়ার আহবান জানানো হবে; অন্যথায় তাদের সাথে যুদ্ধ করা হবে। কাফিরদের প্রণীত কথিত ভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে পৃথিবীতে এত বড় পরিবর্তন আসবে বলে বিশ্বাস করাটা কি বোকামি নয়?
পঞ্চদশ কারণ :
দ্বীনকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী করার জন্য প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী জিহাদ পরিচালনা করবে। কারণ, দ্বীন ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জন্য নয়; বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
যদি মুসলিমরা অক্ষম না হয় এবং শত্রুর সাথে কোনো চুক্তি না থাকে, তাহলে ইসলামি রাষ্ট্রকে পার্শ্ববর্তী কুফরি রাষ্ট্রে আক্রমন চালাতে হবে এবং তাদেরকে হয় ইসলাম, নয় জিজিয়া, নয় যুদ্ধের নীতিতে আহবান জানাতে হবে। এই জিহাদকে ‘জিহাদুত তলব’ বলা হয়। প্রত্যেক বছরে কমপক্ষে একবার এই ধরনের আক্রমন পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজন হলে একবারের বেশীও করা আবশ্যক হয়ে যায়।
ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
وَأَقَلُّ مَا يُفْعَلُ مَرَّةً فِي كُلِّ عَامٍ؛ لِأَنَّ الْجِزْيَةَ تَجِبُ ع
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন