শিরক ফিল মুহাব্বাত (ভালোবাসার মধ্যে শিরক)

কোন ব্যক্তি যদি কোনো বস্তু বা মানুষকে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার চাইতে বেশি কিংবা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার সমান ভালোবাসে তাহলে সেটা হবে শিরক। ওই ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসায় গায়রুল্লাহকে অংশীদার সাব্যস্ত করল।
وَمِنَ النَّاسِ مَنۡ يَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَنۡدَادًا يُّحِبُّوۡنَهُمۡ كَحُبِّ اللّٰهِؕ وَالَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡٓا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰهِ ؕ
“এবং (এতদসত্ত্বেও) মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে (তাঁর প্রভুত্বে) অংশীদার সাব্যস্ত করে, যাদেরকে তারা ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মত। তবে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে।”- (সূরা বাকারা- ১৬৫)
.
তাওহীদের দাবী হল লা মাহবুবা ইল্লাল্লাহ, লা মাক্বসুদা ইল্লাল্লাহ, লা মাতলুবা ইল্লাল্লাহ। অর্থাৎ আসল মাহবুব (ভালোবাসার পাত্র), মাক্বসুদ (চরম লক্ষ্য), ও মাতলুব (প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য) এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِين
“(হে নবী! মুসলিমদেরকে) বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের খান্দান, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।” -(সূরা তাওবা- ২৪)
.
আল্লামা ইকবাল বলেন-
ইয়ে মালো-দাওলাতে-দুনিয়া, ইয়ে রিসাতা-ও পেওয়ান্দ
বুতানে ওয়াহমো গুমা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অর্থাৎ এই দুনিয়া, মাল ও সম্পদ, এই রক্ত ও বন্ধুত্বের বন্ধন নিঃসন্দেহে এ হল তোমাদের মাথায় চেপে থাকা মূর্তি- তোমরা যার উপসনা করছ। জেনে রাখো আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।
.
এখানে ৫টি তথা পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের বন্ধনের কথা বলে হয়েছে। এরপরে ৩টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। প্রথম এসেছে সম্পদের কথা, যে সম্পদের দিকে তাকিয়ে আপনারা খুশি হন। বছর শেষে ব্যালেন্স দেখে মনে মনে সম্পদের মুল্যের হিসাব টানেন। এবং ওই বড় বড় ইমারত বিল্ডিং যা আপনি খুব শখ করে বানিয়েছে, যা আপনার কাছে অত্যাধিক প্রিয়। কুর’আনে বলা হয়েছে এমন ভাবে বানিয়েছেন যেন চিরদিন এখানেই থাকবেন। আর আপনার ওই ব্যবসা যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করেন। এই ৮টি জিনিষের কথা উপর্যুক্ত আয়াতে বলা হয়েছে। এই ৮টি হল ওই মূর্তি আপনারা যার উপসনা করছেন। এসবের উপাসনা ছাড়ুন তাহলেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র হক আদায় হবে।
.
সম্পদের প্রতি ভালোবাসা যদি আপনাকে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করতে উদ্বুদ্ধ করে, হারাম মাধ্যম ব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে, আপনার মন যদি বলে সম্পদ অর্জন করতে হবে তা হালাল ভাবে হোক বা হারাম ভাবে, জায়িজ ভাবে হোক বা নাজায়িজ ভাবে। তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুণ, কে হল আপনার আসল ভালোবাসার পাত্র? সম্পদ। হ্যাঁ এই সম্পদ আপনার মা’বুদ হয়ে গেছে। অনেকে আজ এই শিরক সম্পর্কে গাফেল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ধ্বংস হোক আব্দুদ দীনার ও আব্দুদ দিরহাম। অর্থাৎ দীনার ও দিরহামের বান্দারা ধ্বংস হোক। নাম হল আব্দুর রহমান কিন্তু বাস্তবে সে হল আব্দুদ দীনার ও আব্দুদ দিরহাম বর্তমানে আব্দুদ ডলার। যেভাবেই হোক দীনার-দিরহাম, ডলার-ইউরো অর্জন করতে হবে, তাহলে ভাবুন কে আপনার আসল মা’বুদ?
.
হিন্দুরা কি করছে? তারা লক্ষ্মী দেবীর উপসনা করে। লক্ষ্মী হলেন সম্পদ অর্থের দেবী। তার পূজা কেন করছে? যাতে দেবী খুশি হয়ে সম্পদ দেয়। তাই না? আমরা তথাকথিত মুসলিমরা বললাম হটাও এই দেবীকে আমরা সোজা সম্পদের পূজা করব। তাহলে আর আমাদের ও মুশরিকদের মাঝে কী পার্থক্য রয়েছে? আব্দুদ দীনার আব্দুদ দিরহাম হল শিরক ফিল মুহাব্বাত। ইবাদাতের রূহ হল মুহাব্বাত, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। আজ আমরা তা খুইয়ে চলেছি।
.
আজকের যুগে আরেকটি ভালোবাসার পাত্র তৈরি হয়েছে। এটা হল দেশপ্রেম। আমার দেশের জন্য যা ভালো তা আমরা করব, সেটা আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও করব। এটা হল রাষ্ট্রপূজা। এই উপাসনার একটি নামাযও আছে। রাষ্ট্র সঙ্গীত বাজলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে, এটা হল এই ধর্মের নামায। মুসলিম হয়ে কি আমরা ভুলে গেছি এভাবে দাঁড়ানো আল্লাহর ইবাদাতের একটি অংশ? পতাকার দিকে হাত তুলে সালাম কর, এটা জাতীয়তাবাদ মাজহাবের ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান। আমার রাষ্ট্রের জন্য যা উত্তম, ইসলামের সাথে বা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে যাক বা না যাক আমরা তা করব। এটা কী রকম দ্বীন? এখানে রাষ্ট্র তোমার মা’বুদে পরিনত হয়েছে।
.
আমি (ড. ইসরার আহমেদ রহিমাহুল্লাহ) যখন বলেছিলাম, “পতকাকে সালাম করা শিরক এবং রাষ্ট্রীয় সঙ্গীতের সময় দাঁড়ানো শিরক” তখন পাকিস্তানে খুব প্রতিবাদ হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে সাধারণত আমি যাই না, তবে যদি লোকেরা খুব জোড় দেয় তখন আমি যাই কিন্তু সঙ্গীত বাজলেও আমি দাঁড়াই না। এটা নিয়ে পরের দিন পত্রিকায় বেশ খবর হয়। কিন্তু আমি নিজের অবস্থানে অনড়, আমার কাছে এটা হল এক ভিন্ন ধর্মের নামায। তোমাদের এই সঙ্গীতে দেশের প্রশংসা করা হচ্ছে, এটা কী? আজকের যুগের সবচেয়ে বড় শিরক হল এটা। শিরক ফিল মুহাব্বাত।
.
.
(ড. ইসরার আহমাদ রহিমাহুল্লাহর একটি উর্দু লেকচার 'শিরক ফিল মুহাব্বাত'-এর বাংলা অনুবাদ)

মন্তব্যসমূহ