বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আফগানিস্তানে আমেরিকার ভবিষ্যৎ হল- এটা তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন হয়ে দাঁড়াবে, সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে তারা, তারাও ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করবে, যেমন ভোগ করেছে তাদের পূর্বসূরি সোভায়েট এবং ব্রিটিশরা। ইং শা আল্লাহ। - আমিরুল মু'মিনিন তৃতীয় উমর
ভূমিকা
আফগান যুদ্ধের প্রায় ১৮ বছর হতে চলেছে, কিন্তু যুদ্ধ যেন শেষই হচ্ছে না। যুদ্ধের শুরুতে অধিকাংশের বিশ্বাস ছিল কয়েক সপ্তাহ বা বড়জোর কয়েক মাসে তালিবান আত্নসমর্পণ করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা হল একমাত্র যুদ্ধ যেখানে প্রতিপক্ষের বিপরীতে পুরো দুনিয়া একত্র হয়েছিল। ন্যাটোর ৪৮ টি দেশ একত্রে কেবল মাত্র একটি দেশের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। এমন যুদ্ধের ফলাফল কী হবে তা সহজে অনুনেয়। কিন্তু ১৭ বছর ধরে যুদ্ধ চলবে তা কেউ ভাবেনি। যুদ্ধের শুরুতে তালিবান তোরাবোরা পাহাড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, আমেরিকান বাহিনী চতুর্দিক হতে তাদের উপর চরম হামলা করে এমনকি বিদেশে নিয়োজিত তালিবান প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতদের ধরে ধরে গোয়ান্তানামো কারাগারে পাঠানো হয়।
বর্তমান অবস্থা পুরোই বিপরীত। ১৭ বছর পর আমরা দেখি, অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে তালিবান তোরাবোরা থেকে বের হয়ে আফগানিস্তানের শতকরা ৭০ ভাগ দখল করে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শাসন পরিচালনা করছে। আফগানিস্তানের মোট ৪০০ জেলার ২৫০+ জেলায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আমেরিকার সেইফ হোম বলে পরিচিত স্থানেও তালিবান আরামে হামলা করছে। প্রতিদিন এভারেজে ৪৫ জন আফগান সেনা মারা যাচ্ছে। অসম যুদ্ধের এমন অবাক করা ফলাফল দেখে অনেকের বিশ্বাস হচ্ছে না।
১৭ বছর পরে আমেরিকার জেনারেল ঘোষণা করেছে, 'এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়'। আমেরিকা বলছে এই যুদ্ধে তারা জিততে পারবে না। এমনকি তারা এখন তালিবানকে সন্ত্রাসী নামে ভূষিত করছে না, বলছে তারা হল রেভ্যুলিউশনালিস্ট। ১৭ বছর ধরে যাদেরকে জঙ্গি বলা হয়েছে তারা এখন আর জঙ্গি নয়- কী অদ্ভুত!। যাদেরকে কয়েক সপ্তাহে ধ্বংস করে দিবে বলে দাবী করেছিল তাদের সাথে এখন শান্তি আলোচনায় বসতে আমেরিকা সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। গত এপ্রিলে তালিবান নতুন করে সিজনাল অপারেশন 'আল খন্দক' শুরু করে এবং ইতোমধ্যে তারা অনেক সফলতা পেয়েছে। ফলে এত বছর পর তালিবানের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু হল। মস্কো ফরমেট হয়েছে গত মাসে, এটা তালিবানের অনেক বড় সফলতা। তারা এখন ইসলামী ইমারাহ আফগানিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অচিরেই হয়তো আমরা খোরাসানে পূর্ণ ইসলামি শাসন কায়েম হতে দেখতে পাবো।
প্রথমে ভেবেছিলাম ওরেয়া মাকবুলের শুধু সাক্ষাৎকার নিয়ে নোট পোস্ট করব কিন্তু পরে এই বিষয়ে আরও লেখার ইচ্ছে থাকায় সাম্প্রতিক তালিবানের অগ্রগতি এবং ইসলামী ইমারাহ আফগানিস্তানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনার পূর্বে পয়েন্টস আকারে আলোচ্য বিষয়সূচি জানিয়ে দেয়া জরুরি মনে করছি-
- পাকিস্তানী কলামিস্ট ওরেয়া মাকবুল জানের সাক্ষাৎকার
- ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানের আয়তন
- আফগান যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা
- সংশয়ের অপনোদনঃ তালিবানের অস্ত্রের যোগান এবং আফিম চাষ
- Ashley Jackson এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত “তালিবানের ছায়া সরকারের অধীনে জন-জীবন” রিপোর্টের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
পাকিস্তানী কলামিস্ট ওরেয়া মাকবুল জানের সাক্ষাৎকার
(ব্রাকেট বদ্ধ এবং ইটালিক ফন্টের লেখা গুলো আমার লেখা, বিষয় বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সাক্ষাৎকারের মাঝে মাঝে আমি কিছু আলোচনা করেছি)
যে কোনো রাষ্ট্রের দুটি জিনিস থাকে, প্রথমটি হল ল এন্ড অর্ডার এবং দ্বিতীয়টি হল জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স কালেক্ট করা। অবশ্যই এছাড়াও সরকার বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ও বিভিন্ন সামগ্রী জনগনের কাছে সরবরাহ করে থাকে। আমার সামনে একটি লেখকের প্রবন্ধ আছে। এই প্রবন্ধ মস্কো ফরমেটের কয়েক দিন পূর্বে লেখা হয়েছে, তিনি লিখেছেন, আফগানিস্তানের প্রায় ৭০% তালিবানের নিয়ন্ত্রণে ছিলই এখন পাশাপাশি এই সকল অঞ্ছল থেকে তালিবান ট্যাক্স সংগ্রহ করছে, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করছে, এমনকি তালিবানের নিজস্ব লোগো সম্বলিত বিল স্লিপ থেকে বিদ্যুৎ বিল নেয়া হচ্ছে। বর্ডার এলাকায় তালিবান আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক ও কাস্টমস আদায় করছে। আফগান সরকারের চাইতেও বেশি ট্যাক্স তারা সংগ্রহ করে এখন। আফগান জনগণ জানে যদি দায়িশ (আই এস) তাদের উপর আক্রমণ করে তাহলে আফগান সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, শুধু মাত্র তালিবান তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে। জনগণের বিশেষ প্রয়োজনে এবং ট্যাক্স ও শুল্ক আদায়ের জন্য তালিবানের নিজস্ব মোবাইল ইউনিট রয়েছে।

মস্কো ফরমেটে তালিবানের প্রতিনিধি
আজ থেকে ১৭ বছর পূর্বে মোশাররফের সময়ে, তখন তালিবানের দুই জন ব্যক্তি পাকিস্তানের আফগান এম্বিসেডরে কাজ করছিল। রাষ্ট্রদূত মোল্লা আবদুস সালাম জাইফ এবং ডিপুটি এম্বেসিডর মোল্লা সোহেল শাহিন। মোল্লা সোহেল শাহিন হলেন ওই পাঁচ জনের একজন, যিনি রাশিয়ার মোস্ক ফরমেটে তালিবানের পক্ষ হয়ে অংশ নিয়েছেন। ২০০১ সালে আফগান আক্রমনের সময় তিনি বলেছিলেন, “যদি কেউ ভাবে যে আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে, আসলে সে ভুল ভাবছে, মূলত এটা হল নতুন যুদ্ধের সূচনা।” তখন আমাদের (পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবী মহলে) এই দরস পড়ানো হত যে, আমেরিকার এত টেকনোলজির সামনে কয়েকজন তালিবান কিভাবে যুদ্ধ করবে! তখন আমি বলতাম, ‘না, তাদের একটি আদর্শ রয়েছে। তাদের তাকওয়া আছে। ধৈর্যশীল অল্প সংখ্যক মু’মিন অধিক সংখ্যক কাফিরের উপরে বিজয়ী হবে, আল্লাহর এই ওয়াদায় তারা বিশ্বাস রাখে।’ তখন আমাদের বলা হত, ‘বাকওয়াছ করছ’, আমরা বলতাম ‘আমরা কাদিসিয়া জয় করেছি, ইয়ারমুক জয় করেছি, রোমান ও পারস্যকে হারিয়েছি।’ তারা বলত, ‘ওই যামানায় উভয়ে পক্ষের কাছে তীর, ঢাল, তলোয়ার, বর্ম থাকত। রোম পারস্য শক্তিশালী হলেও তাদের সাথে লড়াই একই প্রকারের অস্ত্র দিয়ে হত। কিন্তু এখন ক্লাশিনকোভের বিপরিতে ড্রোন ও ট্যাংক, রকেট লঞ্চারের বিপরিতে আধুনিক ফাইটার বিমান ও অত্যাধুনিক মিসাইল রয়েছে। অতএব তোমরা মিথ্যা স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর, কয়েকদিনেই আফগান তালিবানরা ধ্বংস হয়ে যাবে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।’

আমাদের পাকিস্তানী সরকারের লোক বলত, ‘আমরা বাধ্য হয়ে আমেরিকাকে সাহায্য করছি অন্যথায় আমাদেরও তোরাবোরা-র মত অবস্থা হত।’ কিন্তু এখন দেখেন, ১৭ বছর পরে কি হচ্ছে, আমেরিকা পাকিস্তানকে চোখ দেখিয়ে কথা বলছে, আর আফগান তালিবানের এই ৫ জন ব্যক্তির সাথে দেখা করতে বিশ্বের বড় বড় দেশ অপেক্ষা করেছে। রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ইন্ডিয়া সবাই। তারা বলে এদের সাথে দেখা করলেই শান্তির আলোচনা হতে পারে অন্যথায় হবে না। এরা সকলে কাতার অফিসে তালিবানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। এরা সকলে এক সময় জেল খেটেছেন বা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছেন। (এই অফিসে অনেকে এমন আছেন যাদের আমেরিকা ধরে গোয়ান্তানামো কারাগারে নিয়ে গিয়েছিল, নিদারুণ নির্যাতন চালিয়েছিল। আজ আমেরিকা এদেরই অপেক্ষা করছে। ইনাদের একজন হলেন সোহেল শাহিন, পাকিস্তানে নিযুক্ত আফগান সাবেক ডিপুটি এম্বেসিডর। মস্কো ফরমেটে তালিবানের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এসেছেন, খুব ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলেছেন এই শিক্ষিত ভদ্রলোক। আরেকজন হলেন মৌলভী শাহবুদ্দীন দিলাওয়ার, তিনি সৌদিতে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তার আগে তিনি জাতিসংঘ, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানে আফগান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।) শাহবুদ্দীন দিলাওয়ার ২০১২ তে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন, তখন তাকে অনেকে ইলেকশনে যাওয়ার উপদেশ দেয়। তিনি বলেন, ‘তোমরা ইলেকশন ভুলে যাও, আমরা অবশ্যই যুদ্ধে জিতবো, আমরা বিজয় ছিনিয়ে দেখাবো।’

মোস্ক ফরমেটে অংশগ্রহনকারী তালিবানের ৫ প্রতিনিধি
(মস্কো ফরমেটে অংশগ্রহণ করেছেন ৫ জন তালিবান প্রতিনিধি। মোল্লা আবদুস সালাম হানাফী- তিনি তালিবানের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আফগান সরকারের হাতে বন্দী হয়েছিলেন, বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে ২০১৩ সালে তিনি মুক্ত হন। মোল্লা জান মুহাম্মাদ মাদানী- প্রথমে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, ২০০১ সালে তিনি আবু ধাবিতে তালিবানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুহাম্মাদ মাদানী এবং মৌলভী শাহবুদ্দীন দিলাওয়ার উভয়ের উপর জাতিসংঘের নিরাপত্ত পরিষদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ইনারা সকলে তালিবানের কাতার অফিসে তালিবানের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাতার অফিসে পরে নিযুক্ত হয়েছেন আরো ৫ জন তালিবানের প্রতিনিধি। তারা হলেন- মোল্লা আব্দুল হক ওয়াসিক, মোল্লা নুরুল্লাহ নুরী, মোল্লা মুহাম্মাদ ফাযাল, মোল্লা খাইরুল্লাহ খাইরখা এবং মৌলভী মুহাম্মাদ নাবি উমারি। তারা সকলে আমেরিকার গোয়ান্তানামো বে কারাগারে বন্দী ছিলেন, ২০১৪ সালে বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে তারা মুক্ত হন এবং সাম্প্রতি কাতার অফিসে তালিবানের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকার সাথে শান্তি আলোচনার দায়িত্ব পালন করছেন।)
আমেরিকা ও ইন্ডিয়া কখনোই চায়নি যে, আফগান তালিবানের সাথে সরাসরি কোনো মিটিং হোক। এবার তো রাশিয়া এই মিটিং করিয়েছে। রাশিয়া জানে তালিবানকে শক্তিশালি করতে না পারলে, আমেরিকার মদদপুষ্ট দাওলা (আই এস) এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলবে। তালিবানের শক্তির অবস্থা দেখুন, এই ফরমেট চলা অবস্থায় তারা আফগান আর্মির দুটি মিলিটারি বেস দখল করেছে। তারা তা ধ্বংস করে দিয়েছে। আর আশে পাশের যত সিকিউরিটি বেইস ছিল সেখান থেকে আফগান ও ফরেন সৈন্যরা ভয়ে পালিয়ে গেছে।

দেখুন এত বড় ফরমেটে আফগান সরকারে কেউ প্রবেশও করতে পারে নি, অথচ পুরো দুনিয়া তাদের বৈধতা দিয়েছে। আর তালিবান সব সময় বলত আমরা শান্তি আলোচনা করলে করব আমেরিকার সাথে যে আসল শত্রু, কোনো কাঠপুতুল সরকারের সাথে আমরা আলোচনায় বসব না। (সাত মাস পূর্বে ওরেয়া মাকবুল জান তালিবানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোল্লা আব্দুস সালাম জাইফের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাতে তিনি জোড় দিয়ে বলেছিলেন আমরা এতটা শক্তি অর্জন করছি যে আমেরিকারকে আমাদের সাথে শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারবো।)

খন্দক অপারেশন পরিচালনারত তালিবান ফাইটার। সোর্স - https://southfront.org/taliban-kills-scores-of-afghan-soldiers-attacks-nato-vehicles-in-kandahar/
(সাধারণত দীর্ঘ যুদ্ধে দুর্বল পক্ষ এক সময় ধৈর্য হারিয়ে বসে, নিরাশা হতাশা তাদের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। ঐক্যে ফাটল ধরে তৈরি হয় অনেক দল ও মত। কমান্ড সেন্টার অকেজ হয়ে যায়। নেতৃত্ব ঝিমিয়ে পড়ে, আনুগত্যহীনতা দেখা দেয়। এর মধ্যে যদি আমির বা সিপাহশালার মারা যান তাহলে বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হল- এমন ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়েও তালিবান এখনো আগের মতই আছে বরং বলা যায় আগের চাইতেও তাদের ঐক্য, আমিরের আনুগত্য, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, মনোবল, শক্তি ও ধৈর্য আরো বেড়েছে আরো সুদৃঢ় হয়েছে। খন্দক অপারেশনের ঘোষণার সাথে সাথে আফগানিস্তানের সকল তালিবান একযোগে তাতে অংশ নেয়, ইদের সময় তিনদিনের যুদ্ধ বিরতির আমিরের আদেশ শুনার সাথে সাথে উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরো আফগান জুড়ে তালিবানের সদস্যরা যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করে ,এই সময়ে একটি গুলিও তারা চালায়নি।)

আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল রাখলে আল্লাহই আপনার জন্য যথেষ্ট হবেন- আফগানরা আবারো এটা প্রমাণ করেছে। এক যুগ ছিল যখন আমরা বলতাম আর মানুষ আমাদের নিয়ে মজা করত। এই এক শতাব্দীতে এই কাওম তিনটি পরাশক্তিকে হারিয়েছে। ব্রিটিশ এম্পায়ার কত বড় ছিলো তা আপনারা জানেন। ব্রিটিশ তখন তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, ওই সময়ে তারা আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি ইংল্যান্ডের ২০ হাজার সৈনিক যারা কাবুলে প্রবেশ করেছিল তারা সবাই নিহত হবে। আফগানিরা একজন ডাক্টারকে ছাড়া সকলকে হত্যা করে। ডাক্টারকে বলা হয়েছিল, ‘যাও তোমার মালিককে বলে দাও এখানে এখনো এমন লোক জীবিত আছে যারা আল্লাহর উপর একনিষ্ঠ ভরসা রাখে।’

দ্বিতীয়বার ৮০র দশকে সোভায়েত ইউনিয়ন আফগানে প্রবেশ করে। তারা তখন অনেক বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। পুরো পাকিস্তানে তখন কমিউনিস্ট মুভমেন্ট চলছিল। সবাই ভাবত যদি রুশ আফগানে টিকে যায় তাহলে পাকিস্তানও তাদের হাতে চলে যাবে। কমিউনিস্টরা বলত ‘পাকিস্তানে কমিউনিস্ট বিপ্লব হবে, মাগরিবের বাতাস এখানে বইতে শুরু করছে, আমরা এদের দেখে নিবো, মৌলভীদের দাঁড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’ আচ্ছা আমরা ধরে নেই, আফগানীদের তখন CIA সাহায্য করেছিল, ISI মদদ দিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ তো তারাই করেছে। রুশের মত শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে ১৪ বছর তারা যুদ্ধ করে এবং এমন ভাবে তাদের পরাজিত করে যে সোভায়েত ইউনিউনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। সর্বশেষে আমেরিকা আফগানে প্রবেশ করেছে, এখন তাদের পতন হচ্ছে। আমেরিকার বহু সেনা ইতোমধ্যে মারা গেছে। অনেকে মেন্টালি ডিসঅর্ডারে ভুগছে। প্রায় প্রতিদিন এভারেজে ৪৫ আফগান সেনা তালিবানের হাতে নিহত হচ্ছে। তালিবানের কাছে প্রযুক্তি নেই, তাদের কাছে ড্রোন ও ফাইটার বিমান নেই, তাদের কাছে ট্যাংক ও আধুনিক সমরাস্ত্র নেই। আল্লামা ইকবালের ভাষায়, -
“আল্লাহ কো পা মারদে-ই-মোমিন পে ভারোসা
ইবলিশ কো ইয়ারোপ কা মাশিনো কা সাহারা”
(অর্থাৎ, মু’মিনদের মাধ্যমে আল্লাহ দুনিয়াতে হক কায়েম রাখেন, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন। মু’মিনরা আল্লাহর উপর ভরসা করে। ইবলিশ ইউরোপের মেশিনের সাহায্যে বাতিল কায়েম করতে চাচ্ছে। আল্লাহর অস্ত্র হল মু’মিনরা আর ইবলিসের অস্ত্র হল ইউরোপের আধুনিক প্রযুক্তি।)
পাকিস্তান এত বছর ধরে আমেরিকার সাহায্য করছে তা সত্ত্বেও ডনাল্ড ট্র্যাম্প যেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। এটা আমাদের অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে যারা মূর্তি পূজা করত তাদের চোখ। মূর্তিটা মাটির মূর্তি ছিল না, সেটা ছিল সুপার পাওয়ার আমেরিকা নামক মূর্তি। তারা তাদের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির মূর্তির পূজা করত। টেকনোলোজির মূর্তির উপাসনা করত। আজ আমার আল্লাহ ওই মূর্তিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। ৯/১১ এর ১৮ বছর হয়ে গেছে, আমি ১৮ বছর আগে থেকে বলছি এই যুদ্ধে আমেরিকা হারবে। অবশ্যই হারবে। কেন হারবে? তার কারন হল আমেরিকার মোকাবেলায় এমন এক কাওম যুদ্ধ করছে যারা ‘এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভরসা করে না’ এই আদর্শ সেট করে নিয়েছে। তৎসময়ে পাকিস্তানের প্রায় সকল নিউজ চ্যানেল আমার কথা নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করেছিল।

দুনিয়ার ইতিহাসে এমন যুদ্ধ আর কখনো হয় নি। ইতিহাসে কখনো এমন হয়নি যে একটি কাওমের বিরুদ্ধে পুরো দুনিয়ার সকল শক্তি একত্র হয়ে যুদ্ধ করছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধেও উভয় দলে বহু দেশ ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভিয়েতনামকে চীন ও রুশ সাহায্য করত। কিউবার যুদ্ধেও একই অবস্থা ছিল। কোরিয়া যুদ্ধে উত্তর কোরিয়াকে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে আমেরিকা সাহায্য করেছিল। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে এটা প্রথম এমন যুদ্ধ যেখানে একদিকে পুরো দুনিয়ার ১৯৯টি দেশ অন্যদিকে একা আফগানিস্তান। ন্যাটোর ৪৮টি দেশ একত্রে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ আজ তাদের জয়েন্ট স্টাফ বলছেন, ‘১৭ বছর ধরে যা হচ্ছে এটা খুবই ভুল ছিল।’ ইতিহাসে এটাই প্রথম যুদ্ধ ছিল যেখানে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করেনি। পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, চীন কেউই আফগানিস্তানের সাথে ছিল না। এমনকি আফগানের তৎকালীন যে রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানে ছিল (মোল্লা আব্দুস সালাম জাঈফ) তাকেও পাকিস্তান আমেরিকার হাতে ধরিয়ে দেয় এবং তাকে তারা গোয়ান্তানামো কারাগারে নিয়ে যায়।

আজ ১৭ বছর পরে আমরা কি দেখছি? ৮০০ বিলিয়ান ডলার খরচ করার পর, হাজার হাজার সেনা নিহত হওয়ার পর সুপার পাওয়ার আমেরিকা আজ বলছে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। আজ তারা পালাতে চাচ্ছে। আজ তারা বলছে তালিবান জঙ্গী বা সন্ত্রাসী নয়। অনেক আমেরিকান সৈন্য যারা আফগানিস্তান থেকে আমেরিকায় ফিরত গেছে তারা মেন্টাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে। পরিবার তাদের ছেড়ে দিচ্ছে। স্ত্রী, বাবা মা সন্তান তাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছে। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য খুঁজে না পেয়ে তারা আত্নহত্যা করছে। (সাম্প্রতি জড়িপে দেখা গেছে, আমেরিকার শতকরা ৫০ ভাগ তরুণ বিশ্বাস করে যে আফগান যুদ্ধে আমেরিকা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে)

আমেরিকা সব সময় ভাড়াটে রাষ্ট্রের ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ করত, আফগানিস্তানে তারা নিজে ফেইস করেছে, বুঝতে পেরেছে বিপদ কত কঠিন হতে পারে। আমি অনেক আগে আফসোস করে বলতাম আমাদের অবস্থাও তোরাবোরা’র মত হলে ভালো হত। আফগানিস্তানে যত লোক মারা গেছে, তারা মৃত্যুর সময় জানতো যে, কোনো কাফিরদের হাতে তারা নিহত হচ্ছে, তাদের ইয়াকিন ছিল যে তাদের মৃত্যু আল্লাহর রাস্তায় হচ্ছে। তারা নিশ্চিত ছিল যে, তারা শহীদ হতে যাচ্ছে। তারা জানতো তারা কুফুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আর আমরা তো এত খারাপ মৃত্যু পাচ্ছি যে, আমাদের কতল কারীও মুসলিম আর কতল হওয়া ব্যক্তিও মুসলিম। আমরা মোশাররফের পলিসির কারনে আমেরিকার যুদ্ধে ৭৫ হাজার মানুষ হারিয়েছি। আমরা তো জানতামই না আমরা যাদের মারছি তারা মুসলিম যাদের হয়ে কাজ করছি তারা কাফির। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? এর চেয়ে উত্তম হত যে, আমরাও আমেরিকার বিরুদ্ধে আফগানের মত দাঁড়িয়ে যেতাম।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে হেলারি ক্লিনটন ‘ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন’-এ একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন। তিনি সেখানে বলেন “এখন থেকে আমরা আমাদের শক্তি ও অর্থ দূর প্রাচ্যে বিনিয়োগ করব।” অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্ছলে। কিন্তু পরে কি হল? তালিবান তাদের ধরে রাখলো। বললো, ‘কোথায় যাচ্ছ? আগে আমাদের সাথে পুরো হিসাব মিটিয়ে নাও।’
একটি কথা বলে শেষ করি, আমেরিকা কখনই তার পরাজয় স্বীকার করে না। ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারার পরেও তা তারা স্বীকার করেনি বরং পরাজয়ের ব্যর্থতার জন্য কম্বোডিয়াকে দায়ী করে তাদের উপর আক্রমণ করে। আমিও এই ভয় পাচ্ছি, আফগানিস্তানে তাদের চরম পরাজয় ও ব্যর্থতার দায় পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে হামলা না করে বসে কিংবা তার এলির মাধ্যমে অর্থাৎ ইন্ডিয়াকে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ শুরু করে না দেয়। আমার মনে হচ্ছে ২০১৯ এর এপ্রিলের পূর্বেই আমেরিকা এমন কিছু করতে পারে (আল্লাহু আলাম)।
ওরেয়া মাকবুল জানের আলোচনা এখানে শেষ। এখন আমরা বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য মিডিয়া ও বিশেষ করে ৫ মাস পূর্বে ব্রিটিশ অভারসি ডেভল্পমেন্ট ইন্সটিউট কর্তৃক প্রকাশিত “তালিবানের ছায়া সরকারের অধীনে জন-জীবন’’ রিপোর্টের আলোকে আলোচনা করব।
ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানের আয়তন

আফগানিস্তানের কত % কার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এ নিয়ে বিভিন্ন সোর্স আলাদা আলাদা তথ্য দিয়েছে। বিবিসির মতে ৭০% অঞ্চলে তালিবানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকান প্রশাসন বলছে ৪৪% অঞ্চলে তালিবানের নিয়ন্ত্রণ অথবা উপস্থিতি রয়েছে আবার আমেরিকান মিলিটারি সোর্স বলছে ৬১% এর কথা। যদিও তালিবান দাবী করে আফগানিস্তানের ৭৫% তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে আমেরিকা আফগান জনগনকে মিসগাইড করছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তবে প্রায় সকলে একমত যে ২০০১ সালের পরে তালিবান এখন সবচেয়ে বেশি অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে আর আফগান সরকার দিনের পর দিন কাবুলে আটকে যাচ্ছে। মোট ৪০৭ টি জেলার প্রায় ২৫০টিতে তালিবানের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

How the U.S. Government Misleads the Public on Afghanistan By ROD NORDLAND, ASH NGU and FAHIM ABED SEPT. 8, 2018
আফগান যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা

১৭ বছরে প্রায় ৩,৫০০ ন্যাটো সেনা ও অফিসার মারা গেছে এর মধ্যে ২,২০০ হল আমেরিকা সৈন্য। আফগান সরকার মতে মোট ২৮ হাজার আফগান সেনা মারা গেছে। সম্প্রতি আফগান সেনার নিহত হবার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০১৬ সালে এভারেজে প্রতিদিন ২২ জন আফগান সেনা তালিবানের হাতে নিহত হয়েছিল, ২০১৮ সালে ওই সংখ্যা এসে দাড়ালো প্রতিদিন ৪৫ জনে। এভাবে একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে না। আফগান সরকারকে অনেকে এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও থিং-ট্যাংকরা আফগান সরকারের পরিবর্তে ‘কাবুল সরকার’ বলা যুক্তিযুক্ত মনে করে। কারন আফগান পোপাট সরকার এখন শুধু কাবুলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে ১৩,৪০০ আমেরিকান সৈন্য আফগানে নিযুক্ত রয়েছে। এর আগে যখন নতুন করে আমেরিকার ৪ হাজার সেনা আফগানে পাঠানো হয় তখন তালিবানের একজন লিডার মোল্লা আব্দুস সাঈদ গার্ডিয়ান নিউজকে সাক্ষাৎকারে বলেন, “৪-৫ হাজার সেনা কি করবে? ১,৫০,০০০ আমেরিকান সৈন্য পাঠালেও আমাদের হারাতে পারবে না। আমেরিকা কৌশল পরিবর্তন করলে আমরাও করি। তাদের সেনারা আমাদের গ্রামে গেলে আমাদের মানুষরা তাদের বের করে দেয়।” আফগান সরকারের হিসাব মতে বর্তমানে তালিবান মুজাহিদের সংখ্যা হল ৭৭ হাজার। যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা কয়েক লাখ হবে বা আরো বেশি। অন্যদিকে আফগান সরকারের সিকিউরিটি ফোরস হল প্রায় ৩,১৪,০০০।

আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধে তারা ইতোমধ্যে ৮৪১ বিলিয়ান ডলার খরচ করেছে। এত খরচ করা সত্ত্বেও তাদের অবস্থা দিনের পর দিন করুণ হচ্ছে। যেকোনো উপায়ে তারা এখান থেকে পালাতে চাচ্ছে। আফগান পোপাট সরকার ও আফগান সেনার ট্রেনিং সহ বিভিন্ন কাঠামো নির্মাণে খরচের পরিমাপ বেড়েই যাচ্ছে।
সংশয়ের অপনোদনঃ তালিবানের অস্ত্রের যোগান এবং আফিম চাষ
রাশিয়া তালিবানকে অস্ত্র সরবরাহ করে বলে আমেরিকা দাবী করেছে, রাশিয়া এই দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মস্কো ফরমেটে আলোচনার পরে সাংবাদিকরা তালিবানের প্রতিনিধির বিশেষ সাক্ষাৎকার নেন। তাতে মোল্লা সোহেল শাহিন বলেন, “রাশান ফেডারেশনের সাথে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে রাশিয়া ইসলামিক এমিরাট অফ আফগানিস্তানকে (তালিবানকে) অস্ত্র সরবরাহ করে। আমরা এটা পুরোপুরি অস্বীকার করি।”
আমেরিকা সম্পর্কে আফগানি একটি প্রবাদ আছে-
"ঘড়ি থাকবে তোমাদের হাতে, কিন্তু সময় চলবে আমাদের ইচ্ছানুযায়ী"

Darra Adam Khel: The Village of Illegal Gun Manufacturers
যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন, তাদের জানা থাকার কথা যে ইসলামের প্রাথমিক যুগের অধিকাংশ যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান অস্ত্রের যোগান হত গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ অস্ত্রের মাধ্যমে। গনিমত হল শ্রেষ্ঠতম রিযিক। আল্লাহ মু’মিনদের গনিমতের মাধ্যমে পুরস্কৃত করেন। আমেরিকানরা আফগান সেনাদের বিভিন্ন রকম অস্ত্র সরবরাহ করে, আবার ন্যাটো ট্রুপ্সের কাছেও অনেক অস্ত্র থাকে, ভীতু সৈন্যের অস্ত্র তালিবান খুব সহজেই দখল করতে পারে। এছাড়া তালিবানের এত বিস্তৃত অঞ্চলে কোথায় কোথায় অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে তা কারই বা জানা থাকতে পারে।

অনেকের কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হয়। তবে যারা আফগান বর্ডারে অবস্থিত পাকিস্তানের Darra Adam Khel শহরের কথা জানেন তাদের নিকট এটা বিস্ময়কর নয়। গুগুল বা ইউটিউবে সার্চ করলে দেখতে পাবেন কত ধরনের গান, রকেট লঞ্ছার ও গোলাবারুদ এখানে তৈরি হচ্ছে। শহরটির ৭৫% পুরুষ অস্ত্র ফ্যাক্টরি ও অস্ত্র ব্যবসার সাথে যুক্ত রয়েছে। এখানের রয়েছে অস্ত্র বিক্রির বড় বড় বাজার। এছাড়া আফগানিস্তানের অনেক স্থানে লুটের অস্ত্র বিক্রি হয়।
অনেকে না বুঝে বলে দেয় তালিবান অস্ত্র পাচ্ছে কোথা থেকে নিশ্চয় আমেরিকা তাদের অস্ত্র দিচ্ছে বা পাকিস্তান। যদি এটা মেনে নেয়া হয় তাহলে এতে প্রমান হয় যে তালিবান আমেরিকা বা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছে। আফগান সরকারের সমর্থিত জনগন মনে করে তালিবান হল পাকিস্তানের প্রোক্সি ফোরস আর ইরান ও পাকিস্তানী মেডিয়া প্রচার করে তালিবান হল আমেরিকার প্রোক্সি আর্মি। আসলে কেউই বাস্তবতা যাচাই না করে কথা বলে অথবা জেনেবুঝে সত্যকে চেপে রাখে। আরেকটি সংশয় হল তালিবানের আফিম চাষ নিয়ে।
মোল্লা সোহেল শাহিনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন, “আপনারা জানেন আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ হত কিন্তু ২০০১ সালের দিকে আমাদের লিডার আফিম চাষ শূন্য লেভেলে নামিয়ে আনেন। একদম বন্ধই হয়ে যায় এটা। কিন্তু আমেরিকার আক্রমণের সাথে সাথে আবার শুরু হয়। আজ আমেরিকার ছায়ায় পৃথিবীর মোট আফিম উৎপাদনের ৯৫ ভাগ আফগানিস্তানে উৎপাদিত হচ্ছে। আমরা আবারো চাই এটা শূন্যে নামিয়ে আনতে কেননা আফিম আমাদের এবং পুরো মানব জাতির জন্য বিপদজনক।” তিনি আরো বলেন, “আমেরিকার একটি সৈন্যেকেও আফগানিস্তানে আমরা বরদাস্ত করব না সবাইকে আফগান ছেড়ে যেতে হবে অন্যথায় শান্তি আলোচনা হবে না।” অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের উত্তর দক্ষিন পূর্ব পশ্চিম সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই, আমাদের বর্ডারে এমন কিছু হতে দিব না ( অর্থাৎ আফিম চাষ) যাতে অন্য দেশের ক্ষতি হয়।”

বিবিসে এক নিউজে বলেছে - “আফগানিস্তানে তালেবানের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। তালিবানের এখনকার হামলাগুলো যেমন বড়, তেমনই বিস্তৃত এবং মারাত্মক। তালিবান সহিংসতা উচ্চমাত্রায় চলে যাওয়ায় আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এখন চাপের মধ্যে আছে, অনেক ক্ষেত্রে, ভীত-সন্ত্রস্তও। তালেবানদের বিস্তার রোধে আফগান বাহিনী কঠোর সংগ্রাম করছে। কিন্তু এ কারণে তাদের হতাহতের হার বিপজ্জনক হারে বেড়েই যাচ্ছে। সামনে তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।”
তালিবানের ছায়া সরকারের অধীনে জন-জীবন
Life under the Taliban shadow government

লেখক ও গবেষক Ashley Jackson ফিল্ড গবেষণা, জরিপ এবং ১৬২ জন তালিবান সদস্য, প্রশাসন কর্মকর্তা, আফগান সরকার ও সাধারণ জনগন এবং তালিবান নিয়ন্ত্রিত শহরের বসবাসরত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। ৩২ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে তিনি আফগানিস্তানের ভিতরে তালিবানের ছায়া সরকারের ধরণ, কাঠামো, প্রশাসন এবং তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে তালিবানের শাসন পদ্ধতি সহ তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এই রিপোর্টের নিউজ করে Washington post নিউজ করেছে The Taliban has successfully built a parallel state in many parts of Afghanistan, report says (অর্থাৎ তালিবান খুব সফল ভাবে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে সমান্তরাল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে) আল জাজিরা’র নিউজ হেডিং ছিল From road tax to courts: The Taliban's attempts at state-building (রোড টাক্স থেকে বিচারালয়ঃ তালিবানের রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা) মূল রিপোর্টে এসলে জ্যাকশন তালিবানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে বলেন, “তালিবানরা রাজনৈতিক দল বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা অথবা নির্বাচন ও রাজনীতিতে অংশ নেয়ার জন্য কাজ করছে না, তারা তো পুরো আফগানিস্তানে শাসনকার্য পরিচালনা করতে নিজেদের তৈরি করছে।” এখন আমরা আফগানিস্তানের ৭০% অঞ্চলে অর্থাৎ তালিবানের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে তালিবানের শাসন ও কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করব।
প্রশাসনিক কাঠামো
অনেকে মনে করে তালিবানের তেমন সাংগঠনিক কাঠামো নেই, নেই কোনো চেইন অফ কমান্ড। এরা বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী দল। বাস্তবতা আসলে এমন নয়, বরং তাদের রয়েছে সুনির্দিষ্ট চেইন অফ কমান্ড, প্রশাসনিক কাঠামো, সাংগঠনিক স্ট্রাকচার। পুরো রিপোর্টে তালিবানকে জঙ্গি সন্ত্রাসী বলা হয়নি, যেমনটা সাধারনত মেডিয়ারা বলে থাকে, তারা জঙ্গির পরিবর্তে তালিবানকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বলেছে। তালিবানের প্রধান নেতৃত্ব রয়েছে আমিরুল মু’মিনিনের হাতে, বর্তমান আমিরুল মু’মিনিন হলেন মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা (হাফিজাহুল্লাহ)। সাধারণত আফগানিস্তানে আমিরুল মু’মিনিন কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু যেহেতু আফগানিস্তানের বহু অঞ্চলে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, তাই এখন তারা যুদ্ধের চাইতে রাষ্ট্র নির্মাণে শক্তি প্রয়োগ করছে। ফলে বর্তমান আমিরুল মু’মিনিন যত না কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার চাইতে বেশি তিনি একজন আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রাহবার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সহকারী হিসেবে আছেন দুই জন ডিপুটি। একজন হলেন আমিরুল মু’মিনিন মোল্লা উমর (রহিমাহুল্লাহ)’র পুত্র ইয়াকুব, আরেকজন হলেন জালালউদ্দিন হাক্কানী (রহিমাহুল্লাহ)’র পুত্র সিরাজউদ্দিন। তাদের রয়েছে শুরা পরিষদ। এই শুরা পরিষদ আমিরুল মু’মিনিন এবং ডিপুটিদের নিয়োগ করে। তাদের আন্ডারে বিভিন্ন কমিশন পরিচালনা হয়। পৃথক পৃথক কমিশনের জন্য পৃথক পৃথক মানুষকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

প্রতিটি রাজ্যে অর্থ, আইন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা আলাদা মিনিস্টার নিয়োগ দেয়া হয়। এদের হেড হিসেবে কাজ করেন প্রাদেশিক গভর্নররা। প্রদেশের পৃথক মিনিস্ট্রির অধীনে কাজ করে জেলা প্রশাসন। প্রত্যেক জেলায় আবার থাকে ডিস্ট্রিক গভর্নর তাদের নিচে থাকে ডিপুটি গভর্নর এবং মেয়র। স্থানীয় কাউকে তারা গভর্নর বানায় না, গভর্নরকে অবশ্য অন্য অঞ্চলের অধিবাসী হতে হবে। আবার এক বছর পর পর গভর্নরদের স্থানান্তর করা হয়। প্রতিটি রাজ্যে এবং জেলায় পৃথক ভাবে উপদেষ্টা পরিষদ তৈরি করা হয়েছে। আলেম এবং বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে এই পরিষদ গঠিত। প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত এই সকল ব্যক্তিবর্গ সিভিলিয়ান নয়, এরা সকলেই মিলিটারি পার্সোনাল। যে কোনো সময় মিলিটারির কমান্ডার হিসেবে কাজ করতে হতে পারে, বলে সাধারণ মানুষকে এই সকল পোস্টে নিয়োগ করা হয় না। সাম্প্রতিক আরো কয়েকটি কমিশন তৈরি করা হয়েছে এদের মধ্যে আছে অনেক গুলো সাব-কমিশন।
অর্থ ও রাজস্ব বিভাগ
ফাইন্যান্স কমিশনের মূল্য দায়িত্বে আছেন তালিবানের একজন প্রতাপশালী কমান্ডার গুল আগা। তিনি আমিরুল মু’মিনিন মোল্লা উমর (রহিমাহুল্লাহ)- এর উপদেষ্টা ছিলেন। অর্থ বিভাগের অধীনে অনেক গুলো সাব ব্রাঞ্ছেস আছে এগুলোর কাজ হল কর ও রাজস্ব আদায়, যাকাত ও উশর সংগ্রহ এবং বণ্টন সহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, কাস্টামস/ডিউটি আদায়, খনিজ সম্পদ আরোহণ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি। এছাড়াও এই কমিশনের অধীনে আলাদা করে কাজ করে পৃথক দুটি কমিশন, পানি ও জ্বালানী কমিশন এবং কৃষি ও ভূমি কমিশন।
তালিবানের রাজস্ব আয় দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উরুযগান প্রদেশ থেকে প্রতিমাসে তালিবানের আয় হয় ২.৫ মিলিয়ন ডলার আর কুন্দুজ প্রদেশ থেকে আয় হয় ১০ মিলিয়ন ডলার। তালিবানরা বছরে ২.৫% হারে যাকাত সংগ্রহ করে। তালিবান নিয়ন্ত্রণে অঞ্চলে যাকাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, কেউ না যাকাত দিতে অসম্মতি জানালে জোর করে আদায় করা হয়। উৎপাদনের ১০ ভাগের এক ভাগ তালিবানরা উশর হিসেবে সংগ্রহ করে থাকে।
তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে প্রাইভেট টেলিকমনিকোশন নিটওয়ারক কোম্পানিকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে, এবং তাদের থেকে তালিবান প্রতিনিয়ত ট্যাক্স আদায় করে। আফগান সরকারের মোবাইল ফোন কোম্পানি ‘সালাম’ সেখানে ব্যান করা হয়েছে। ৭টি প্রদেশের অধিকাংশ ইলেট্রিক বিল তালিবান সংগ্রহ করে, এতে করে আফগান সরকারের ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। একটি সরকারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল রাজস্ব বিভাগ, তালিবান রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে নিজেকে ছায়া সরকার হিসেবে ইতোমধ্যে জনগনের মাঝে প্রতিষ্ঠ করেছে।
বিচার বিভাগ
এই বিভাগের দায়িত্ব পরিচালনা করেন ওলামা পরিষদ। এটা জনগণের মাঝে সবচে’ বেশি প্রভাব বিস্তার কারী কমিশন। এটার তিনটি শাখা রয়েছে। ওলামা কাউন্সিল, দারুল ইফতা (ফাতোয়া কাউন্সিল) এবং আদালত। বিচারালয় বা আদালত হল সবচেয়ে বড় ব্রাঞ্চ। আফগানিস্তানের সকল প্রদেশে এই শাখা কাজ করছে। পাকিস্তানের কোয়েটা এবং পেসাওয়ারেও এই শাখার অফিস রয়েছে। এই শাখায় তিনটি লেভেল আছে- সুপ্রিম কোর্ট, প্রাদেশিক আদালত এবং প্রাথমিক আদালত। কোথাও কোথাও দায়রা জজ আদলত আছে, আছে ডিস্ট্রিক কোর্ট। কোনো কোনো প্রদেশ জেল সহ আদালত আছে কোথাও শুধু মোবাইল কোর্ট এবং ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছে।

Tribal elders hearing a case in Kandahar in December. Afghanistan’s informal justice system also includes Taliban courts.
আফগান সরকারের বিচার বিভাগে অনেক দুর্নীতি হয় ফলে আফগান সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মানুষও দেখা যায় ইনসাফ পেতে তালিবানের বিচার ব্যবস্থার শরণাপন্ন হয়। তালিবানের বিচার ব্যবস্থা খুবই কার্যকর, অল্প সময়ে মানুষ এখানে ন্যায় বিচার পাচ্ছে। এমনো লোক আছে যারা তালিবানকে পছন্দ করে না কিন্তু ইনসাফ পেতে চায় তারাও তালিবানের কোর্টে আসে। এখানে উকিল হায়ার করতে হয় না, বাদী ও বিবাদীর কোনো খরচ হয় না। অন্যদিকে দেখা যায় আফগান কোর্টে গরীবরা টাকা খরচ না করার কারণে ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তালিবানের আইনের মূল্ উৎস হল কুর’আন এবং হাদিস। তারা কুর’আন হাদিসের আলোকে ফায়সালা করে এছাড়াও কিয়াস এবং ইজমার সাহায্য নেয়া হয়। এই বিভাগ আফগান জনগনের মনে বিচারিক ইনসাফ ও নিরাপত্তা পাওয়ার আশা সঞ্চার করেছে। তালিবানের দ্রুতগতিসম্পন্ন, পক্ষপাতহীন, চুড়ান্তনিষ্পত্তিমূলক বিচার ব্যবস্থা আফগান সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসিয়াল বিচার ব্যবস্থার চাইতে অনেক বেশি সফল ও কার্যকরী। এই বিষয় রিপোর্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, বেশ কিছু সত্য উদারহণও বর্ণিত হয়েছে, আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
শিক্ষা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্ডারের কাজ করে জেলা পর্যায়ে শিক্ষা সচিবরা। তারা পুরো জেলার স্কুলের জন্য স্কুল পরিদর্শক (স্কুল মনিটর) নিয়োগ দেয়। এরা হল মূলত মোল্লা ও মৌলোভীগণ, এরাই স্কুলের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। শিক্ষকের উপস্থিতি, শিক্ষার মাণ, ছাত্র উপস্থিতি সহ যাবতীয় কাজের পর্যবেক্ষণ করেন। স্কুলের প্রশাসনিক কাজও এরাই করেন। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগদান করে স্কুল শুরা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তালিবানের শিক্ষা ব্যবস্থা হল মূলত মাদরাসা-বেসড-এডুকেসন।

শিক্ষার ক্ষেত্রে তালিবানের মনোভাবে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। ভালো শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে এবং ক্লাসে ছাত্র উপস্থিতি অনেক বেড়েছে। ছাত্ররা শিক্ষার প্রতি মনযোগী হচ্ছে। যদিও আধুনিক শিক্ষা গ্রহন এবং ইংলিশ ভাষা শিক্ষায় তালিবানের মনোভাব আগের মতই আছে। সাক্ষাৎকারে অধিকাংশ মানুষ বলেছে যে, অভয়ারওল শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা অনেক উন্নত হচ্ছে।
তালিবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আফগান সরকারের যে শিক্ষা ক্যারিকুলাম ছিল তারা তা থেকে প্রথমেই আফগান সংস্কৃতি, সংবিধান ও আইন বিষয়ক সাবজেক্ট বাতিল করে, ইসলামি শিক্ষা সংযুক্ত করে। জেনারেল স্কুলগুলোতেও মাদরাসার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্রদের জন্য আফগান ট্র্যাডিশনাল ড্রেস (আলখাল্লা) এবং বয়স হলে দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। তালিবানের সাথে ছাত্র সময় কাটায়, তারা তাদের বিভিন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয় এবং মসজিদে অধিক সময় কাটাতে ছাত্রদের উৎসাহ দান করে। সাক্ষাৎকারী একজন শিক্ষক বলেন, “মাঝে মাঝে স্কুলে সিনিয়র তালিবানরা পরিদর্শনে আসেন এতে স্টুডেন্টদের ব্যবহারে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।”

Children attending school in Kandahar, Afghanistan
আফগান সরকার নিয়ন্ত্রিত শহরের ইউনিভার্সিটি গুলোতেও তালেবানের বেশ প্রভাব রয়েছে। কুন্দুজ শহরের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক বলেন, “তালিবান ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা বিল্ডিং-এ পড়ানোর জন্য চাপ দেয়, এতে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বিরোধীতা করে, পরে তালিবানের চাপে ক্লাসের মাঝে পর্দা লাগিয়ে ছেলে ও মেয়ে স্টুডেন্টকে পৃথক করে ক্লাস করাতে হচ্ছে।” আফগান সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোতে দুর্নীতি প্রবল। শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, খাতা না দেখে নাম্বারিং, ঘুষ নিয়ে পাস করানো ইত্যাদি অনেক বেশি। অন্যদিকে তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের স্কুল একদম আলাদা, সেখানে শিক্ষক উপস্থিতি ভালো, পরিক্ষা ও ফলাফলে দুর্নীতি নেই, পুস্তক সময়ে বিতরিত হচ্ছে, এমনকি ক্লাসেও নির্দিষ্ট অর্ডার রয়েছে। তালিবানের জন্য শিক্ষকরা ভয়ে থাকেন, ক্লাসে তালিবানের স্পাইও থাকে। ক্লাসের ছাত্ররা জানে যে তাদের ক্লাসমেটের মধ্যে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ তালিবানের সদস্য পড়াশুনা করছে। ওয়ারদাকের একজন শিক্ষক বলেন, “ঐ সকল ছাত্ররা পড়াশুনায় ভালো নয়, কিন্তু তালিবানরা এসে বলে যে, তাদের পারিবারিক সমস্যা আছে তাই ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছে না। আসলে এটা সত্য নয়, মূলত তারা রাতে যুদ্ধ করে তাই তারা ক্লাসে মনোযোগী হতে পারে না।” শিক্ষা নিয়ে রিপোর্টে অনেক আলোচনা রয়েছে, এর পরে তারা নারী শিক্ষায় তালিবানের মনোভাব নিয়ে বেশ মায়া কান্না করেছে।
স্বাস্থ্য
রিপোর্টে দেখা যায় যে তালিবানরা এই বিষয়ে বেশ মনোযোগী হয়েছে। তারা আফগান সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং প্রাইভেট ক্লিনিক এমনকি বিদেশী NGO দের সাথেও প্রয়োজনে সম্পর্ক বজায় রাখে। আফগান সরকারের ক্লিনিক গুলোতে দুর্নীতি ব্যাপক, অন্যদিকে তালিবান নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিকগুলোতে ভালো সার্ভিস দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আফগান গভের ক্লিনিক গুলো অনেক বেশি ঝামেলাপূর্ণ।
স্টাফ নিয়োগের কাজ শূরা পরিষদের উপর তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে, সাধারণত স্ব স্ব সেকটরে দক্ষ লোককে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়। স্টাফদের উপস্থিতি তারা চেইক করে। মেডিশিনের মেয়াদ কেমন এবং যন্ত্রপাতির সচল আছে কি না তা হেলথ কমিশন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। জুরুরি মেডিসিন এবং সেবার মূল্য তালিবান নিয়ন্ত্রণ করে, কোথাও কোথাও তালিবানের অনুমতি নিয়ে সরকারী চিকিৎসা সংস্থাও তালিবান নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক ও হসপিটাল পর্যবেক্ষণ করে থাকে। স্বাস্থ্যের মত স্পর্শকাতর বিষয়ে আফগান সরকারী কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাবানরা অপেশাদার ডাক্টার স্টাফ নিয়োগ বা ভেজাল টেন্ডার গ্রহনের জন্য চাপ দেয় অন্যদিকে তালিবান সরকার এমনটা করে না, তারা এটার গুরুত্ব বুঝে। সরকারী অফিসার, ক্লিনিক স্টাফ এবং NGO কর্মকর্তারা বলেছেন International Humanitarian Law (IHL) সম্পর্কে তালিবানদের যথেষ্ট বুঝ রয়েছে এবং তারা স্বাস্থ্য সেবা সরবরাহের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যথেষ্ট সম্মান করে। আগে তালিবান মিলিটারিতে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব ছিল, কর্মী সংখ্যাও ছিল অল্প কিন্তু এখন তালিবানের প্রটিটি ১০টি কমান্ড জোনের এরিয়াতে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, মেজর সমস্যাতে আগের মত তাদের এখন পাকিস্তানে যেতে হয় না।
সমাজ ব্যবস্থা
তালিবানের নিজস্ব সামাজিক নীতি ও আইন রয়েছে যেমন, তালিবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে টিভি, রেডিও এবং স্মার্ট ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। পুরুষদের দাড়ি রাখতে হবে, মুসলিম তামাদ্দুনের পোশাক পড়তে হবে, মাহরাম পুরুষ ব্যতীত মহিলারা বাজারে বা দূরে যেতে পারবে না, মিউজিক বাজানো বা শুনা যাবে না। সিগারেট পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রত্যেক মানুষকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ অবশ্যই পড়তে হবে এবং প্রতিটি দোকান জুমার নামাজের সময় বন্ধ থাকতে হবে। বাজারে তালিবানরা পেট্রলিং করে, যদি কারোর চুল অনেক বড় বা স্টাইলিশ থাকে তাহলে তা তারা কেটে দেয়। তালিবান কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে জনগনকে তাদের নিয়মনীতির সাথে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলছে, তারা তাদের কাজে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে যদি কেউ তাদের নিয়ম নীতি অনুসরণ করতে না চায় সে যেন তাদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
পরিশেষে..
আলহামদুলিল্লাহ্! ৫০০০+ শব্দের এই বিশাল নোটটি অবশেষে শেষ করতে পেরেছি। প্রথমে ভাবিনি এত বড় হয়ে যাবে। পুরো নোটে কোথাও আমি নিজ থেকে কোনো তথ্য যুক্ত করিনি, প্রতিটি তথ্য গ্রহণযোগ্য মিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। তালিবানের নিজস্ব নিউজ মেডিয়ার তথ্য এখানে উপস্থাপন করিনি কেননা অধিকাংশের কাছে তাদের প্রদত্ত তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না তাই এখানে পশ্চিমা ইয়াহুদি নাসারা ও তাদের দোসর যা প্রচার করেছে শুধু ঐ তথ্যই নেয়া হয়েছে। ইং শা আল্লাহ, নোটটি সময়ের সাথে সাথে আপডেট করার চেষ্টা করব।
শেষ কথা, তালিবানের পথ ও পদ্ধতিতে, তালিবানের অগ্রগতিতে শিক্ষা রয়েছে আমাদের জন্য, বিশেষ করে শিক্ষা রয়েছে-
- গণতান্ত্রিক ধারায় লিপ্ত ইসলামি জামায়াতের জন্য
- ইলম চর্চারত মাদরাসা কেন্দ্রিক ওলামা-তলাবার জন্য
- আকিদার সংশোধনের দিকে আহবানকারী সালাফীদের জন্য
- তাযকিয়া ও খানকা নিয়ে ব্যস্ত পীর মাসায়েখের জন্য
- তালিমে নিবিষ্ট তাবলীগ জামায়াতের জন্য
- মসজিদের খতিব-ইমামের জন্য
পরিশেষে মাকবুল জানের ভাষায় বলবো-
তালিবানের অবস্থা আমাদের অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে যারা মূর্তি পূজা করত তাদের চোখ। মূর্তিটা মাটির মূর্তি ছিল না, সেটা ছিল সুপার পাওয়ার আমেরিকা নামক মূর্তি। তারা তাদের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির মূর্তির পূজা করত। টেকনোলোজির মূর্তির উপাসনা করত। আজ আমার আল্লাহ ওই মূর্তিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। ৯/১১ এর ১৮ বছর হয়ে গেছে, আমি ১৮ বছর আগে থেকে বলছি এই যুদ্ধে আমেরিকা হারবে। অবশ্যই হারবে। কেন হারবে? তার কারন হল আমেরিকার মোকাবেলায় এমন এক কাওম যুদ্ধ করছে যারা- এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভরসা করে না।

“আমার জন্য তো আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করেছি, আর তিনি হচ্ছেন অতি বড় আরশের মালিক।”
সূত্র-
- ওরেয়া মাকবুল জানের আলোচনা- https://www.youtube.com/watch?v=43dQQNkOkhE&t=1517s
- https://www.youtube.com/watch?v=bzoaOMPDFZ4&fbclid=IwAR3M2ivfYX5eOfGve0Xg3erKvQfNm1b0XY5i3pEPJYHGxO3OCjMMVxtJlU0
- মোল্লা আব্দুস সালাম জাইফি’র সাক্ষাৎকার- https://www.youtube.com/watch?v=oxppHbdMBJs - Life Under Taliban Shadow Government PDF - https://www.odi.org/publications/11144-life-under-taliban-shadow-government
- https://www.reuters.com/article/us-afghanistan-taliban-finance/taliban-tax-collectors-help-tighten-insurgents-grip-in-afghanistan-idUSKCN1NB19Y
- https://www.youtube.com/watch?v=KlXnpoH7T-Q
- https://www.bbc.com/news/world-asia-42863116
- https://www.bbc.com/news/av/world-asia-42881987/taliban-threaten-70-of-afghanistan-bbc-investigation-finds
- https://www.nytimes.com/2018/09/21/world/asia/afghanistan-security-casualties-taliban.html
- https://www.nytimes.com/interactive/2018/09/08/world/asia/us-misleads-on-afghanistan.html
- https://www.amusingplanet.com/2014/09/darra-adam-khel-village-of-illegal-gun.html
- https://southfront.org/taliban-kills-scores-of-afghan-soldiers-attacks-nato-vehicles-in-kandahar/
- https://www.aljazeera.com/news/2018/08/road-tax-courts-taliban-attempts-state-building-180817101909543.html
- https://www.nytimes.com/2015/02/01/world/asia/taliban-justice-gains-favor-as-official-afghan-courts-fail.html
- https://www.bbc.com/bengali/news-45532165
- https://www.washingtonpost.com/news/worldviews/wp/2018/06/21/the-taliban-has-successfully-built-a-parallel-state-in-many-parts-of-afghanistan-report-says/?utm_term=.fc63d2905ead
- https://uk.reuters.com/article/uk-france-security/police-hunt-across-eastern-france-for-strasbourg-christmas-market-attacker-idUKKBN1OB0LQ?il=0
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন