অমীমাংসিত জহির রায়হান.....

 



০১.
“... তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও একটি প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। প্রশ্নটি হচ্ছে - জহির রায়হানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের নিস্পৃহ আচরণ। একটি মানুষ যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, গণআদালত করে গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই।
সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে - পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশটির লক্ষ্য ছিল - বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবিসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নি:শেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে তারপর আর ফিরে আসেনি। এ মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে।
তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আল শামস্, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায় - মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিব বাহিনী।
১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এ বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল - রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নি:শেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোন মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিব বাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে॥”
— নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি ॥ [ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৪০৫-৪০৬ ]
 ০২.
“... তিনি (জহির রায়হান) যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্যই ঢাকা ছেড়ে আগরতলা এবং পরে কলকাতা চলে যান।কলকাতায় তিনি প্রচার কাজ সংগঠিত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পতিত হন এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হতে হয়।
... "স্টপ জেনোসাইড" ছবিটি নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে শুটিং করতে দেয় নি, এমন কি কোন কোন সেক্টরে তাঁর গমন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।
... আওয়ামী লীগের নেতারা ছবি দেখে ছাড়পত্র না দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সেন্সর বোর্ডকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
... ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর শহিদুল্লাহ কায়সারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে জহির রায়হান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন।
... বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে হানাদার বাহিনীর সহযোগী বহু চাঁই ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য তিনি আওয়ামী নেতৃত্বকেও দায়ী করেন। মুজিবনগর সরকারের সকল গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন বলেও ঘোষণা করেন।
... তাঁর উপস্থিতি যাদের জন্য অস্বস্তিকর তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে এটা খুব স্বাভাবিক। ৭২ এর ৩০শে জানুয়ারী মিরপুরে তাঁর অগ্রজকে (শহিদুল্লাহ কায়সার) খুঁজতে গিয়েছিলেন। তদন্ত করলে হয়ত জানা যেতো সেই অজ্ঞাত টেলিফোন কোত্থেকে এসেছিল, যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিল শহিদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে আছেন।
... এটাও বিস্ময় যে তাঁর (জহির রায়হানের) অন্তর্ধান নিয়ে কোন তদন্ত হয় নি। কেন হয় নি অনুমান করতে অসুবিধে হয় না॥” 
  শাহরিয়ার কবির
তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান (ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) ॥ [ পল্লব পাবলিশার্স - আগস্ট, ১৯৯২ । পৃ: ১৩-১৬ ]
০৩.
সত্যজিত রায় : জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?
শাহরিয়ার কবির : তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায় ৩০ জানুয়ারি দূর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
সত্যজিত রায় : স্ট্রেঞ্জ ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
শাহরিয়ার কবির : সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুর দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবিদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সেজন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল॥
— সত্যজিত রায়-এর সাক্ষাৎকার / সাপ্তাহিক বিচিত্রা - ০১ মে, ১৯৯২
“... জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখি হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড়বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন - 'জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এরকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে'। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরও সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে॥”
— সুমিতা দেবী ( জহির রায়হানের প্রথমা স্ত্রী) / সাক্ষাৎকার / দৈনিক আজকের কাগজ - ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৩
“... জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুঁয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটি কোন কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এল। মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না॥”
— অনল রায়হান (জহির রায়হানের মেজো ছেলে) / সাক্ষাৎকার / দৈনিক বাংলা - ৯ আগস্ট, ১৯৯৯
০৪.
মুজিব : অনেকে ত দালালী করে মরেছে।
 নাফিসা কবির : বুদ্ধিজীবীরা কেউ দালালী করে মরেনি। দালালী যারা করেছে তারা এখনও বেঁচে আছে। সে দালালদের বিচারের দাবী জানাতে এসেছি॥
[ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে শহীদুল্লাহ কায়সারের বোন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ মুজিবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কালে ]
— মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে / পান্না কায়সার [ আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১ । পৃ: ১৬৮ ]
 ০৫.
নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান
[ ২৮ বছর পর মিরপুর রণাঙ্গনের এক সৈনিকের বর্ণনায় ৩০ জানুয়ারির অন্তর্ধান রহস্যভেদ।]
“... বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি কিভাবে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন গতকাল পর্যন্তও জাতি তা জানতাে না। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে ৩০ জানুয়ারি পালিত হয়ে এসেছে জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে। কিন্তু সেদিন তিনি হারিয়েও যাননি, পাক হানাদার বাহিনী তাকে কোনাে অজ্ঞাত স্থানে ধরেও নিয়ে যায়নি। তাদেরই দোসর বিহারী-রাজাকারদের বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন বাঙালির গর্ব জহির রায়হান। সেদিন মিরপুরে বীরের মতাে যুদ্ধ করতে করতে বেঁচে এসেছিলেন এমনই একজন সৈনিক আমির হােসেনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই চাঞ্চল্যকর তথ্য, ইতিহাসের অন্ধকার দিক। নিভৃতচারী ঐ সৈনিকের খোঁজ পাওয়া যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড়াে ভাই সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান ১২ নম্বর সেকশনের পানির ট্যাংকি এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর বিহারি রাজাকারদের সংঘবদ্ধ সশস্ত্র হামলার শিকার হন। অবাঙালি বিহারিদের ছোড়া বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ অজ্ঞাতস্থানে টেনে নিয়ে যায় বিহারিরা। সেই থেকে গুম জহির রায়হান। সেই থেকেই দীর্ঘ ২৮ বছর ইতিহাস অন্ধকারে।
স্বাধীনতার পর গােটা মিরপুরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নির্দিষ্টভাবে এ দিনের ঘটনাবলী থেকে এমনটাই অনুমান করা যায় যে, বিহারি রাজাকারদের ঐ হামলায় শহীদ হন জহির রায়হান। পরে অন্যদের মতাে তার রক্তাক্ত দেহও গােটা এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোনাে কুয়া বা ডােবা-জলাশয়ে ফেলে দেয় বিহারিরা, যেসব স্থানে এখন আবিষ্কৃত হচ্ছে বধ্যভূমি। জহির রায়হান যেখানে গুলিবিদ্ধ হন, সেই মিরপুর ১২ নং সেকশনের ভিতরে পানির ট্যাঙ্কির কাছেই গড়ে ওঠা মাদ্রাসা দারুর রাশাদ-এর পিছনেও রয়েছে পুরােনাে কুয়া এবং ডােবা। অবশ্য এখন সেখানে বস্তি এবং বিপুল জনবসতি।
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ভিতরে পানির ট্যাঙ্কির কাছে ঐদিন অস্ত্র উদ্ধার এবং এলাকা দখলমুক্ত করার অভিযানে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের একটি যৌথ দল। সাহিত্যিক, সাংবাদিক জহির রায়হান ছিলেন তাদেরই সঙ্গে। কিন্তু সকাল ১১টার দিকে পুলিশ এবং সৈন্যরা পজিশন নিতে না নিতেই তাদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ শুরু করে অবাঙালি বিহারিরা। বিহারিদের গুলির মুখ থেকে বেঁচে আসা সৈনিক আমির হােসেনের মুখ থেকেই স্বাধীনতাৱ ২৮ বছর পর ইতিহাসের এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
সেদিন এ হামলার সময় তিনিই জহির রায়হানকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেন। প্রচণ্ড দুঃখ, ক্ষোভ ও অভিমানের সুরে তিনি ইতিহাসের অনুঘটিত সেই মর্মান্তিক অধ্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই সৈনিক নামে চিনতেন না জহির রায়হানকে। তবে তাদের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে জহির রায়হানকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন সাংবাদিক হিসেবে। সেদিন জহির রায়হানের অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে ছিল তার অবস্থান। তাদের প্রতি সেদিন নির্দেশ ছিল ঐ সাংবাদিকসহ অন্যদের পাহারায় থাকা। ইউনিফর্ম পরিহিত সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাইরে একমাত্র সাংবাদিক জহির রায়হানই ছিলেন সিভিল পােশাকে। তার গায়ে ছিল কালাে প্যান্ট, সাদা শার্ট ও হালকা হলুদ রঙের সােয়েটার । আমির হােসেন ঘটনাস্থলে প্রথম তাকে দেখেন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে। জহির রায়হান যেমনটা ফর্সা ও হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন তার বর্ণনাও ঠিক তেমনই। শেষদিন জহির রায়হান যে পােশাক পরে বেরিয়েছিলেন বলে তার চাচাতাে ভাই শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন, আমির হােসেনের দেওয়া বর্ণনা তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। প্রসঙ্গত, সেদিন শাহরিয়ার কবির জহির রায়হানকে মিরপুরে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।
চারদিক থেকে অবাঙ্গালিদের আকস্মিক আক্রমণ ও গুলিবর্ষণে হতভম্ব হয়ে যখন এদিক সেদিক দেখছিলেন এই সৈনিক তখন আৱেকবার তার চোখে পড়ে জহির রায়হানকে। জহির রায়হান গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। অবাঙালিরা টেনে নিয়ে যায় তাকে। জহির রায়হানকে কোথায় টেনে নিয়েছিল অবাঙালিরা সে তথ্য উদঘাটিত না হলেও আমির হােসেন জানিয়েছেন, জহির রায়হানের মতাে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া সেনা ও পুলিশ সদস্যদের অবাঙালিরা টেনে-হিচড়ে নিয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন দিকে। তবে '৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মিরপুর মুক্ত হওয়ার পর ১২ নম্বর সেকশনসহ বিভিন্ন এলাকার বিল, ডােবা, নিচু জমি, টিলা, কুয়াসহ নানা স্থানে শহীদদের দেহ অবাঙালিরা ফেলে দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের সময় আরাে অনেক বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর মতােই জহির রায়হানের বড়ো ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকার, আলবদররা। তাকে আর পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার দেড় মাস পর '৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে কে বা কারা টেলিফোনে জহির রায়হানকে জানিয়েছিলেন, শহীদুল্লা কায়সারসহ আরাে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের কোথাও বন্দী করে রাখা হয়েছে। এ খবর পেয়ে জহির রায়হান সেই সকালেই বিহারি অধ্যুষিত মিরপুরে ছুটে যান। কিন্তু তারপর তিনিও আর ফিরে আসেননি।
সেদিনই মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে অবাঙালিদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার এবং মিরপুৱকে দখলমুক্ত করতে গিয়ে আকস্মিক আক্রমণের শিকার হন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা। সেদিনের সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাদের অনেকেই। কিন্তু জহির রায়হান সম্পর্কে সঠিক কোনাে তথ্য ২৮ বছরেও জানা যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন না শহীদ হয়েছেন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি, আলােচনা ও বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু মীমাংসা হয়নি।
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে মুসলিম বাজার বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হলে মিরপুরে ১২ নম্বর সেকশনে স্বাধীনতার দেড় মাস পর '৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সংঘটিত যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় সেই যুদ্ধের সৈনিক আমির হােসেনের খোঁজ মেলে।
আমির হােসেন ১৯৮২ সালে নায়েক হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৬৯ সালে একজন সিপাহি হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ৩০ জানুয়ারি মিরপুরের যুদ্ধের আগেই আমির হােসেন পদোন্নতি পেয়ে ল্যান্স নায়েক হয়েছিলেন। তিনি জানান, মিরপুর যুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ নম্বর কোম্পানির (ডি কোম্পানি) ১২ নম্বর প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। তাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন হেলাল মােরশেদ (পরে বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত একজন মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন) এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মমিন, যিনি ৩০ জানুয়ারি মিরপুরের যুদ্ধে শহীদ হন।
আমির হােসেন ৩০ জানুয়ারি মিরপুরের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, ৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদেরকে মিরপুরে টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাদেরকে জানানাে হয়, মিরপুরে অবাঙালিদের কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। সেগুলাে উদ্ধার করার জন্য পুলিশবাহিনীকে সহযােগিতা করতে হবে। পরদিন ২৮ জানুয়ারি ১২ নম্বর প্লাটুনকে মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের মাজারের কাছে একটি পরিত্যক্ত স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পরদিন ২৯ জানুয়ারি বিকালে প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার মমিনের সঙ্গে আমির হােসেনসহ ৬ সন সৈনিক একটি পিকআপ ভ্যানে ১২ নম্বর সেকশন এলাকা রেকি করতে যান। আনুমানিক বিকাল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে সেই এলাকার একটি পানির ট্যাংকির পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০/৭০ জন অসামরিক লােক অবাঙালি বিহারি তাদের পিকআপ ঘেরাও করে। তারা উর্দু ও বাংলা ভাষা মিলিয়ে পানি ও খাবারের অভাবের কথা জানায় এবং এগুলাে না দিলে তাদের গাড়ি আটকে রাখার হুমকি দেয়। সুবেদার মমিন তাদেরকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করলে তাদের পিকআপ ছাড়া পায় এবং তারা মিরপুর ১ নম্বরের স্কুলে ফিরে আসে।
সেদিনই সন্ধ্যায় আমির হোসেনদের জানানাে হয়, ৩০ জানুয়ারি সকালে ১২ নম্বর সেকশনে তাদের অস্ত্র উদ্ধার করতে যেতে হবে। ৩০ জানুয়ারি আনুমানিক সকাল ৭টার দিকে তাদেরকে গাড়ি করে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি যে গাড়িতে ছিলেন তার আগেই তাদের কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মােরশেদ কয়েকজন সৈনিক নিয়ে সেখানে চলে যান। আমির হােসেনদের পিছনে ছিল পুলিশের গাড়ি।
তিনি জানান, সবগুলাে গাড়ি ১২ নম্বর সেকশনে পানির ট্যাংকির কাছে গিয়ে থামে। সেনা ও পুলিশের সকল সদস্য সেখানে নামেন। এরপর সেখান থেকে ১২ নম্বর প্লাটুনের ৩টি সেকশনকে (১, ২, ও ৩ নম্বর সেকশন) পানির ট্যাংকির আশপাশের এলাকায় তাদের অবস্থান নির্ধারণ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেবল পানির ট্যাংকির সঙ্গেই একটি চৌরাস্তার কাছে আমির হােসেন ও সিপাহী আকরামকে পাহারায় রাখা হয়।
আমির হােসেন জানান, তখন এলাকাটা অনেক ফাঁঁকা ছিল। আশপাশে ঘর-বাড়ি ছিল খুব কম। নিচু জমি ও জলাশয় ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের দায়িত্ব ছিল 'কেউ এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় অস্ত্র পাচার' করে কিনা তা লক্ষ্য রাখা। এ ছাড়াও সেখানে পুলিশের অফিসার, একজন সাংবাদিক ও মেজর সাহেব আছে জানিয়ে তাদেরকে দেখাশুনা ও কোনো বিশৃঙ্খলা যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুবেদার মমিন।
আমির হােসেন বলেন, সেই সাংবাদিক জহির রায়হান ও পুলিশের অফিসারদের তিনি চিনতেন না, নামও জানতেন না। কিন্তু সুবেদার মমিন যেহেতু তাদেরকে দেখাশােনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাই, ৪০/৫০ গজ দূর থেকে তিনি পুলিশ অফিসার ও ঐ সাংবাদিকের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন।
তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রথম আমি সাংবাদিক সাহেবকে দেখি। পানির ট্যাংকির পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশের দুজন অফিসারের সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন। তাদের পাশে 'শখানেক পুলিশ সদস্য ছিলাে। আমির হােসেন বলেন, আনুমানিক ১১ টায় ঢং ঢং করে কয়েকটা পাগলা ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাই। এর পরপরই দক্ষিণ দিক থেকে গুলির শব্দ শুনি। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি পুলিশের অনেক সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সেখানেই একটি ইটের স্তুপের পিছনে আমি অবস্থান নিই। তখন তাকিয়ে দেখি পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিক সাহেবও যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তার পাশেই পানির ট্যাংকির দেয়ালের পাশে তার দেহ পড়ে আছে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার ভঙ্গিতে দেয়ালের ওপর পড়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক সাহেবের জামার বড়ো অংশ জুড়ে রক্তের দাগ দেখতে পাই। এর আগেই উত্তর দিক থেকেও বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ঘটনার ২০ বছর পরও এ বর্ণনা দেওয়ার সময় আমির হােসেন আবেগ ও উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। মনে হচ্ছিলাে যেন রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই কথা বলছেন। যেন আবারও অস্ত্র হাতে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এখনই ছুটবেন তিনি।
অভিযােগের সুরে আমির হােসেন বলেন, গােলাগুলি হতে পারে এমন কোনাে ধারণাই আমাদের ছিল না। এ ধরনের কোনাে আশঙ্কার কথাও বলা হয়নি। ফলে বৃষ্টির মতো' গুলিবর্ষণ এবং সবাইকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে তিনি বুঝতে পারেন পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে গেছে। তখন তিনি তার প্রথম অবস্থা থেকে কিছুটা পিছিয়ে একটি দেয়াল ও তার পাশে খেজুর গাছের আড়ালে চলে যান এবং তার হাতের এলএমজিটা দক্ষিণ দিকে তাক করেন।
তিনি বলেন, পুলিশের সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকে গুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখনই সিভিল পােশাকে' একশ জনের মতাে বিহারি দাছুরিসহ নানা ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। তারা উর্দুতে গালিগালাজ এবং কাউকেই ছাড়া হবে না বলে চিৎকার করছিল। অবাঙালিরা দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা তাদেরকে ধারালাে অস্ত্র দিয়ে কোপানাে শুরু করে এবং টেনেহিঁচড়ে পানির ট্যাংকির পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এসময় পড়ে থাকা সাংবাদিককেও (জহির রায়হান) ৬/৭ জন অবাঙালি হাত, ঘাড়, কোমর ধরে টেনে নিয়ে যায় পানির ট্যাংকির পশ্চিম দিকে।
আমির হােসেন বলেন, অবাঙালিরা দল বেঁধে এগুতে এগুতে তার অবস্থানের খুব কাছাকাছি চলে আসলে তিনি নিজেকে বাঁচানাের জন্য এলএমজি দিয়ে গুলি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করেন। তাদের অনেকে তখন আহত হয়ে পড়ে যায় । অবাঙালিরাও পাল্টা তার ওপর গুলি চালায়। তিনি বলেন, তখন পূর্ব দিক থেকে কম গুলি আসছিল। অন্য তিনদিক থেকে বৃষ্টির মতাে গুলি হচ্ছিল। ফলে তিনি গুলি করতে করতে পূর্বদিকে সরে যান । সেদিকে সরে এসে তার সঙ্গে দেখা হয় হেলাল মােরশেদের। সারা রাত ধরে পূর্বদিকের কাদাপানি ডিঙিয়ে সকালে তিনি ক্যান্টনমেন্টে পৌছান।
দীর্ঘ ২৮ বছর এ ঘটনা তিনি কাউকে বলেননি কেন জানতে চাইলে তীব্র ক্ষোভ ও অভিমানের সঙ্গে আমির হােসেন বলেন, “কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমাকে, মুক্তিযুদ্ধের কথা তাে এখন কেউ শুনতেই চায় না। তাই ভুলে যেতে চেয়েছি যে আমিও মুক্তিযােদ্ধা ছিলাম।" বর্তমানে বালুর সাপ্লায়ার আমির হােসেন বলেন, সংবাদপত্র তার পড়া হয় না। কোনাে খোঁজ খবর তিনি রাখেন না। কিছু বাসায় টেলিভিশনে মিরপুরে নব আবিষ্কৃত মুসলিম বাজার বধ্যভূমির খনন কাজ ও শহীদদের দেহাবশেষ দেখতে দেখতে আবেগ ও উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠেন তিনি। তার ভাষ্য আমার চোখে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে মিরপুরের সেই যুদ্ধের ঘটনাগুলি। তখনই আমি স্ত্রী, সন্তানদের বলি আমিও ঐ যুদ্ধে ছিলাম। আমাদের মানুষই ঐখানে শহীদ হয়েছে। তার সহযােদ্ধা সিপাহী আকরামও মিরপুরে যুদ্ধ থেকে বেঁচে আসেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে তার সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ নেই বলে আমির হােসেন জানিয়েছেন।
মুসলিম বাজার বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে প্রায় এক মাস ধরে মিরপুরের ৩০ জানুয়ারির যুদ্ধের ঘটনা ও বধ্যভূমির অনুসন্ধান করতে গিয়ে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের সাক্ষাৎকার ইতিমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে। তাদেরই একজন সেনাবাহিনীর সাবেক সুবেদার মােখলেসুর রহমান (যিনি ৩০ জানুয়ারি মিরপুরের যুদ্ধে ছিলেন) সেই ইতিহাস অনুসন্ধানে ভােরের কাগজ এবং, মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মাের্শেদকে সহায়তা করতে গিয়ে আমির হােসেনের সন্ধান করেন। মোখলেসুর রহমান সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে আমির হােসেনকে খুঁজে আনেন ঢাকায় এবং ভােরের কাগজ-এর সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেন। তৎকালীন কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মাের্শেদের সঙ্গে গত সােমবার আমির হােসেনের সাক্ষাৎ হলে তিনি তাকে ৩০ জানুয়ারির মিরপুর যুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করেন। আমির হােসেন মিরপুরে সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়েও শনাক্ত করেছেন ঘটনার স্থানগুলাে॥”
তথ্যসূত্র : দৈনিক ভোরের কাগজ / সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ইং
০৬.
“... ভারতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং চিত্র নির্মাতা কাজী জহির রায়হান। তিনি জেনেছিলেন অনেক কিছু, চিত্রায়িতও করেছিলেন অনেক দুর্লভ দৃশ্যের। কিন্তু অতসব জানতে বুঝতে গিয়ে তিনি বেজায় অপরাধ করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই তাকে সেই অনেক কিছু জানার অপরাধেই প্রাণ দিতে হয়েছে বলে সকলের ধারনা। 
 ভারতের মাটিতে অবস্থান কালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চুরি, দুর্নীতি, অবৈধ, ব্যবসা, যৌন কেলেংকারী, বিভিন্ন রূপ ভোগ-বিলাস সহ তাদের বিভিন্নমূখী অপকর্মের প্রামাণ্য দলীল ছিল - ছিল সচিত্র দৃশ্য। আওয়ামী লীগের অতি সাধের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজী জহির রায়হানের এতবড় অপরাধকে স্বার্থান্বেষী মহল কোন্ যুক্তিতে ক্ষমা করতে পারে? তাই বেঁচে থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী রূপ দেখে যাওয়ার সুযোগ আর হয়নি জহির রায়হানের। 
 আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নম্বর আসামী স্টুয়ার্ড মুজিবেরও ঘটেছিল এই পরিণতি। এই দায়িত্বশীল নিষ্ঠাবান তেজোদীপ্ত যুবক স্টুয়ার্ড মুজিব আমার ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে এবং পরে ৮ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। তার মত নির্ভেজাল ত্বরিতকর্মা একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা সত্যিই বিরল। প্রচন্ড সাহস ও বীরত্বের অধিকারী স্টুয়ার্ড মুজিব ছিল শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয় অন্ধভক্ত। মাদারীপুর থানার অন্তর্গত পালং অধিবাসী মুজিবকে দেখেছি বিদ্যুতের মতই এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটোছুটি করতে। কি করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করা যায়, ভারতের কোন্ নেতার সাথে যোগাযোগ করলে মুক্তিযুদ্ধের রসদ লাভ করা যায়, কেবল সেই চিন্তা এবং কর্মেই অস্থির দেখেছি স্টুয়ার্ড মুজিবকে। মুজিব ভারতে অবস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক কুকীর্তি সম্পর্কেই ছিল ওয়াকেবহাল। এতবড় স্পর্ধা কি করে সইবে স্বার্থান্বেষী মহল। তাই স্বাধীনতার মাত্র সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ঢাকা নগরীর গুলিস্তান চত্বর থেকে হ্যাইজ্যাক হয়ে যায় স্টুয়ার্ড মুজিব। এভাবে হারিয়ে যায় বাংলার আর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।
 ভারতে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরগুলোও ছিল নানান কুকর্মে লিপ্ত আওয়ামী নেতৃত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই সচেতনভাবেই তারা ট্রেনিং শিবিরগুলো এড়িয়ে চলত। এ সকল ট্রেনিং শিবিরে অবস্থান করত সাধারণ জনগণের সন্তান, যাদের ভারতের অন্যত্র কোন ধরনের আশ্রয় ছিল না। যারা হোটেল, কিম্বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে তারা আর মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরের ধারে-কাছেও ভেড়েনি, অংশগ্রহণ করাতো দুরেই থাক। 
 এ ধরনের সুবিধাভোগীগের নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে ভারতীয় স্পাই সংস্থা ‘র’ (RAW) মেজর জেনারেল ওভানের মাধ্যমে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বিশেষ বাহিনী গঠনে হাত দেয়। এই বাহিনীতে বাংলাদেশ ছাত্র লীগের অবস্থাসম্পন্ন সদস্যরাই কেবল অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের ট্রেনিং পরিচালনা করা হয় ভারতের ‘দেরাদূন’ শহরে। তাদের জন্য বিশেষ সুবিধে এবং অন্যান্য আরাম-আয়েসের সুব্যবস্থা ছিল। ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন ছিল বাংলার সাধারণ জনগণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের বিকল্প ব্যবস্থা। ‘মুজিব বাহিনীর’ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের পুর্বেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তাদের দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যই বলা চলে যে, সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে তাদের রক্ত ঝরাতে হয়নি। তাদের অভিজাত রক্ত সংরক্ষিত করা হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ঝরানোর লক্ষ্যে॥”
— মেজর (অব:) এম এ জলিল / অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা ॥ [ কমল কুঁড়ি প্রকাশন - ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ । পৃ: ৩৯-৪১ ]
০৭.
 একটি চিঠি
[ ভারতে জহির রায়হান পরিচালিত একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রতিবাদে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক ফজলুল হক-এর চিঠি। সূত্র: বাংলাদেশ সরকার, রাষ্ট্রপতির দফতর। তারিখ : ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ইং ]
 জয় বাংলা
 বাংলাদেশ সরকার 
 রাষ্ট্রপতির কার্যালয় 
 Memo No. PS/ SEC/ III/ II0, Dated 10th Sept., 1971
 To
 The Prime Minister,
 Government of Bangladesh 
 Sub : - Letter of Mr. Fazlul Huq, regarding exhibition of a documentary film produced by Mr. Zahir Raihan.
 Please find enclosed copy of the letter of Mr. Fazlul Huq, the film producer-Director of Bangladesh. The letter is self-explanatory. I would request you to kindly look into the charges levelled by Mr. Fazlul Huq and decide the matter on its own merit keeping in view the best interest of our country.
 Action taken in this respect may please be intimated to me in due course.
 (Syed Nazrul Islam)
 Acting President
 Enc 1 Copy of letter
 (1 sheet)
 … … …
Sir,
 This is to to put a serious matter, in my belief a matter of great National Importance, before your honour regarding a documentary film directed by Zahir Raihan, which we have viewed to-day in a private show in Calcutta.
 This documentary is being financed by Eastern India Motion Picture Association and being produced by Bangladesh Chala Chitra Silpi o Kalakushali Samity in association with Bangladesh Liberation Council of Intelligentsia. This would be sold to Indian Government to show it in India and other countries.
 The film start with a photo of V.I. Lenin and with his wordings shows nothing but little of refugees in India and a little part of our Liberation Army Training Camp. But the serious set back is, in my opinion, that there is not a single shot or word about our beloved leader Bangabondhu Sheikh Mujibur Rahman or Awami League or the Six Points.
 I believe if this film is shown in India or abroad, the viewers shall have the belief that our liberation is being guided by something else and not the points we believe in.
 If the film has been made by any Indian Director, we shall reserve our comments, but when it is made by a Director of Bangladesh we cannot sit idle.
 I, personally, protest against this film and I request you to immediate action to stop this film before it is shown to the public through the Indian Government.
 If it is not done, I alone, am ready to start a movement.
 With deepest regards,
 Sd/- Fazlul Huq 
 Film Producer-Director of Bangladesh 
 C/o. Mr. Benoy Roy, 114/A, Park St.
 Calcutta - 17
 * উল্লেখ্য জনাব ফজলুল হক চ্যানেল আইয়ের পরিচালক একুশে পদকপ্রাপ্ত ফরিদুর রেজা সাগরের পিতা।
তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (প্রথম খন্ড) / সম্পাদনা : মাহমুদউল্লাহ ॥ [ গতিধারা - মার্চ, ১৯৯৯ । পৃ: ৪৬০-৪৬১ ]
 ০৮. 
চলচিত্রাভিনেত্রী কবরীর সাথে জহির রায়হানের কিছু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের স্থিরচিত্র। ছবি : সংগৃহীত॥
০৯.
 “... এদিকে ৩১ জানুয়ারি থেকে পত্রপত্রিকায় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার খবর বের হতে থাকে। কিছু লােক, সম্ভবত তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধব, মিরপুরে এসে তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন আমি তাকে নামে চিনতাম না বা তার সম্পর্কে বিশেষ জানতাম না। এরই মধ্যে একদিন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যার নাম আজ মনে নেই, সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি জহির রায়হানের ছবিও নিয়ে আসেন। তিনি সৈন্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার অনুমতি চান। বিস্তারিত আলাপের পর আমি ওইদিন মিরপুরে উপস্থিত সৈন্যদের কয়েকজনের সঙ্গে তার কথা বলার ব্যবস্থা করে দিই। সেনাসদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তিনি আবার আমার অফিসে আসেন। আলাপে তিনি আমাকে জানান, 'আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং আমাদের তদন্তে মনে হচ্ছে জহির রায়হান সৈন্য ও পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের সময় বিহারিদের গুলিতেই নিহত হয়েছেন।'
অবশ্য এর আগেই আমরা যখন নিজেদের সদস্যদের হতাহতের খোঁজখবর তথা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করি, তখনই সৈন্যদের সঙ্গে একজন বাঙালি বেসামরিক লােক নিহত হয় বলে তথ্য বেরিয়ে আসে। ঘটনা বিশ্লেষণে বােঝা যায় যে, তিনিই ছিলেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানের মিরপুর যাওয়া নিয়ে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত আছে। তবে এটা সত্যি যে, তিনি তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজেই মিরপুর যান। ভােরবেলায় তিনি মিরপুরে গেলে সৈন্যরা তাকে ভেতরে যেতে বাধা দেয়। পরে সৈনিকেরা তাকে ২নং সেকশনে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হেলাল মাের্শেদের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মাের্শেদ তখন পুলিশ ও তাঁর প্লাটুন কমান্ডারদের নিয়ে সমন্বয়সভায় ব্যস্ত। ক্যাপ্টেন মাের্শেদকে তার আসার উদ্দেশ্য জানানাের পর তিনি দূর থেকে সংশ্লিষ্ট সেনাসদস্যকে বলেন যে, 'ঠিক আছে তিনি পুলিশের সঙ্গে ভেতরে যেতে পারেন।' এই বলে ক্যাপ্টেন মাের্শেদ তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রাথমিক তদন্তের সময় সাড়ে ১১নং সেকশনে মােতায়েন কয়েকজন জানান, সকাল সাড়ে ৯টা/১০টার দিকে তারা হালক-পাতলা গড়নের একজন বেসামরিক লােককে সাড়ে ১১ ও ১২নং সেকশনের মাঝামাঝি রাস্তায় একা একা হাটতে দেখেন। এ ছাড়া জহির রায়হানের ছবি দেখার পর সৈন্যদের কয়েকজন ওই রকম গড়নের একজনকে সেখানে দেখেন বলে জানান। ১১টার দিকে বিহারিরা সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। অতর্কিত সেই আক্রমণে সৈন্যদের সঙ্গে তিনিও নিহত হন। তবে ঠিক কোন জায়গায় তিনি নিহত হন তখন তা সঠিক কেউ বলতে পারেনি। ৪২জন সেনাসদস্যের মধ্যে তিন-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জহির রায়হানসহ বাকি কারােই মৃতদেহ পাওয়া যায়নি॥”
— মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন (অব:), বীরবিক্রম / এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক ॥ [ মাওলা ব্রাদার্স - ফেব্রুয়ারি, ২০০০ । পৃ: ৩৩-৩৪ ]
১০.
 “... যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জহিরের সাথে আমরা কলকাতা চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির আমাদের রেখেই স্পেশাল ফ্লাইটে বাংলাদেশে চলে এলো ছবি তৈরি করার কথা বলে। ছবিটি করার কথা দেশ স্বাধীনের ওপর ভিত্তি করে। তার কাছে অসংখ্য ক্লিপ ছিল। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রচার করে সে সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। যা-ই হোক, জহির আসার সময় বলেছিল আমাদের দুই দিন পর এসে নিয়ে যাবে। দুই দিনের কথা বলে এসে প্রায় ১৫ দিন তার কোনো খবর নেই। আমাদের ঘরে খাবার নেই, অর্থ নেই, খুবই করুণ অবস্থা। আমাদের পাশেই থাকতেন আলমগীর কবীর। তিনি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন, আমাদের দেখাশোনা করেছিলেন। আমরা পরে শুনলাম জহিরের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ভাইকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত। বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছেন, খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করছেন। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। ও তো কাজপাগল মানুষ ছিল, অনেকটা আত্মভোলার মতো। কাজের সামনে স্ত্রী-সন্তান তার কাছে বড় ছিল না। অবশেষে ১৬-১৭ দিন পর আলমগীর কবীর সাহেব আমাদের জন্য প্লেনের টিকিট কেটে দিলেন। আমরা বাংলাদেশে এলাম। আসার কয়েক দিন পর বাংলাদেশে থেকে আমরা আবার কলকাতায় গেলাম। কলকাতা থেকে আসার পর বাসায় মিথ্যা টেলিফোন করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে জহিরকে নিয়ে যাওয়া হলো। জহির কিন্তু আমাদের কিছুই বলত না। আমি উপরে থাকতাম, জহির নিচে লোকজনদের নিয়ে প্ল্যান করছে, কী করা যায়। জহিরকে নিয়ে যাওয়ার পর সে আর ফিরে আসেনি। এমনকি তার মৃতদেহও আমরা পাইনি।
ঠিকানাঃ কাউকে কি সন্দেহ হয় বা অন্য কিছু মনে হয়?
সুচন্দাঃ কিছু না কিছু মনে তো হয়ই। আজ পর্যন্ত আমি এ বিষয়টি বলিনি এবং এখনো বলতে চাই না। যে বিষয়টি আড়ালে রয়ে গেছে, আমি তাকে মনের অন্তরালেই রাখতে চাই। কারণ সব কথা সব সময় বলা যায় না, বললে অনেক সময় বিপদ এসে যায়। যে বিপদটা জহিরের জীবনে এসেছিল। জহির বেঁচে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ প্রেস ক্লাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিল ‘যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় বড় নেতা মনে করেন, তাদের কীর্তি কাহিনী, কলকাতায় কে কী করেছিল, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেবো।’ এ কথা জহির মুখ দিয়ে প্রকাশ্যে বলার পরই তার ওপর বিপদ নেমে আসে। এ বলাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল।
ববিতাঃ (সুচন্দার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) জহির ভাইকে বলা হলো যে, তোমার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত আছে, মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরে চিলেকোঠার একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে, তার দুটো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, তবে সে জীবিত আছে। তুমি যে তোমার ভাইকে উদ্ধার করতে যাচ্ছ, এটি তোমার মা, স্ত্রী ও আত্মীয়দের বলবে না।
সুচন্দাঃ জহির যখন যায় তখন দু-তিনটি স্মৃতি আমার মনে এখনো গেঁথে আছে যেটি কোনো দিনই ভুলার নয়। ভুলতে পারব না। আমি বুঝতেই পারলাম না যে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে এখনই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ডাকবে সুচন্দা, দরজা খোল, আমি এসেছি। এভাবেই কেটে গেল অনেক দিন। আমার মনেই হয় না জহিরকে কেউ মেরে ফেলবে, জহিরকে কে মারবে? জহির মরতেই পারে না। জহির রায়হানের মতো লোককে তো কেউ মারতে পারে না। কারণ বাংলাদেশের সবাই জহির রায়হানকে চেনে।
ববিতাঃ জহির ভাই যে দিন বাসা থেকে বের হয়ে যান সেই দিন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার জহির ভাইয়ের সাথে ছিল এবং সেই দিন রাতে আমাদের বাসায় ডিনার ছিল। ওই ব্রিগেডিয়ার আমাদের ফোন করে জানাল স্যরি, তোমাদের ডিনারে যাওয়া হচ্ছে না। আমি জহিরের সাথে যাচ্ছি।
সুচন্দাঃ এ রকম নয়। ঘটনার দিন সকালে আমাদের বাসায় একজন লোক এলো। খবরটি জহিরকে দিতেই সে তড়িঘড়ি করে নামাজ পড়ে নিচে নেমে গেল। সেই সময় আমি নাশতা তৈরি করে নিয়ে এলাম। জহিরকে নাশতা করতে বললাম। সে বললঃ আমার সময় নেই। জুতা পরছিল। আগেই বলেছি, জহির একটু আত্মভোলা ছিল। জামা-কাপড়ের প্রতি তার কোনো খেয়াল ছিল না, সব সময় তাকে আমার জামা-কাপড় দিতে হতো। বলতে হতো এটা পরো, ওটা পরো। জুতা পরার সময় আমি বললাম, তোমার মোজা তো ময়লা হয়ে গেছে, এটি খুলে রেখে যাও। সে আমার কথা শুনল না। বলল না না, আমি এখন যাই। আমি আসার পর তুমি এটি ধুয়ে দিও। জহির দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে চলে গেল, আমি তার পায়ের আওয়াজ পেলাম। ২ মিনিট পর সে আবার ফিরে এলো এবং আমাকে বলল সুচন্দা, আমাকে কিছু টাকা দাও তো। কারণ তার কাছে কখনো টাকাপয়সা থাকত না। টাকাপয়সা সে সব সময় তার ভাই বা তার ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে রাখত। আমাকে বলল আমার কাছে তো টাকা নেই। আমি তখন আলমারি খুলে তাকে টাকা দিলাম। ওই দিন বাংলাদেশে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিস, ওয়াহিদা রহমান, লতা মুঙ্গেশকরসহ অনেক বড় বড় শিল্পী এফডিসিতে এসেছিলেন। হাসান ইমাম সাহেব ফোন করলেন। আমাকে ফোন করে বললেন ম্যাডাম, জহির ভাই কোথায়? আমি বললাম জহির নেই, সে বাইরে গেছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, জহির ভাই না হলে তো হবে না। তবে উনি যেহেতু নেই, আপনাকে তো অবশ্যই আসতে হবে। এত বড় বড় শিল্পী এসেছেন আপনি ও জহির ভাই না এলে কেমন দেখায়? শহীদুল্লাহ কায়সারকে আমি বড়দা বলতাম। এ পরিস্থিতিতে আমারও খারাপ লাগছে বড়দা নেই। জোরাজুরি করার পর অগত্যাই আমি গেলাম। 
 সেখান থেকে আসার পর আমি দেখলাম সবাই বসে আছে। টেলিফোন সামনে। আমি বাসার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের মেজদা কোথায়? তারা বলল, মেজদা তো মিরপুরে গিয়েছিল, আমাদের তো সাথে নেয়নি। মেজদার তো এখন কোনো খোঁজ নেই। আমি বললাম মেজদার খোঁজ নেই মানে? তারা আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিলো মিরপুর থানা। টেলিফোনের ওই প্রান্ত থেকে জানাল ধরুন, একজনকে দিচ্ছি। ফোনে মেজর মইন ও মেজর মতিউর রহমান দু’জন জানালেন আপনি একটু পর ফোন করেন। কারণ আমাদের দরকারি টেলিফোন এসেছে। আমি বললাম, ঠিক আছে। তার কিছুক্ষণ পর আমি আবার ফোন করলাম। তারা তখন জানাল উনি তো অপারেশনে আমাদের পুলিশ-আর্মির সাথে ভেতরে ঢুকেছেন, কিন্তু ওইখানে একটু গণ্ডগোল হয়েছে, গুলিগালা হয়েছে, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বললাম কী বলেন? উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? তারা আরো জানাল আমাদের অনেক লোক উন্ডেড হয়েছে এ কথা বলেই টেলিফোন রেখে দিলো। আমি পরে মেজর মইন ও মতিউর রহমানের সাথে দেখা করতে যাই। তাদের কাছে জানতে চাই জহির কোথায় গেল, কীভাবে গেল? উনারা এসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর আমাকে দিতে পারেননি। আমি খুব মনোক্ষুণ্ন হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি॥”
— “জহির ও যুদ্ধের অনেক কথা রেকর্ড করে যাবো মৃতুর পর সবাই জানবে” শিরোনামে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক ঠিকানা' পত্রিকায় প্রকাশিত জহির রায়হানের স্ত্রী কহিনুর আক্তার (সুচন্দা) ও তার বোন ফরিদা আক্তার (ববিতা)'র সাক্ষাৎকার / ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪
১১.
 “... জানুয়ারি মাসের ২৭-২৮ তারিখের দিকে কথা উঠল যে, তৎকালীন ঢাকার মিরপুর এলাকায় অনেক পাকিস্তানি সেনাসদস্য এবং তাদের স্থানীয় উর্দুভাষী সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ লুক্কায়িত আছে। কথা উঠল যে, তাদের নিরস্ত্র করতে হবে এবং এলাকাটিকে মুক্ত করতে হবে। ওই সময় পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্তে বৃহত্তম সহযোগী শক্তি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোই দৃশ্যমান ছিল। এই পর্যায়ে কথা উঠল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দিয়ে মিরপুর অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করা সমীচীন হবে না। এই অভিযান পরিচালনা করতে হলে বাংলাদেশী সেনা-ইউনিটকেই কাজে লাগানো উচিত। যেই কথা সেই কাজ। তৎকালীন নবীন বাংলাদেশ সরকার থেকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার-ইন চিফ বা প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে ‘এস ফোর্স’-এর অধিনায়কের মাধ্যমে আদেশ এলো যে, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে এই কাজে লাগানো হোক। আদেশ প্রাপ্তির পর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও রেওয়াজ মোতাবেক সম্ভাব্য অপারেশনাল এলাকা পর্যবেক্ষণ তথা রিকনাইসেন্স (ইংরেজি সংক্ষিপ্ত শব্দ হলো ‘রেকি’) করার কোনো সুযোগ আমরা পেলাম না। আদেশ প্রাপ্তি থেকে নিয়ে মিরপুর এলাকায় অপারেশন শুরু করা পর্যন্ত সময়ের তফাত ছিল ৪৮ ঘণ্টার কম। পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী, প্রস্তুতি ছিল অপর্যাপ্ত।
লেফটেনেন্ট সেলিমসহ হতাহতের বর্ণনা:
জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ দিনের শেষে গভীর রাতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী মিরপুর এলাকায় গেলেন (বর্তমান ১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছাকাছি এলাকায়) এবং একটা খালি বাড়িতে মাত্র পাঁচ-ছয়জন সৈনিককে নিয়ে ব্যাটালিয়নের অগ্রবর্তী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলেন। আমি ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটেন্ট রমনা রেসকোর্সেই থাকলাম। আলফা (অর্থাৎ ‘এ’) কোম্পানি বঙ্গভবন পাহারা দিচ্ছিল। সেই কোম্পানির অধিনায়ক এবং ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর মো: মতিউর রহমান (পরে বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল, আজ থেকে আঠারো বছর আগে অবসরে যাওয়ার দুই মাস আগে মরহুম)। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের ৯ তারিখ রণাঙ্গনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন পেয়ে একই সাথে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা সহোদর ভাই আমাদের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। একজন হলেন কামরুল হাসান ডাকনাম সেলিম, আরেকজন হলেন আনিসুল হাসান। সেলিমকে মিরপুরে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে আনা হলো অতি প্রত্যুষে। ব্যাটালিয়নের ডেলটা (অর্থাৎ ‘ডি’) কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান (পরে বীর বিক্রম, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান)। পুরো ‘ডি’ কোম্পানিকে অতি প্রত্যুষে মিরপুরে একত্র করা হলো; সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম লেফটেন্যান্ট মোর্শেদের সহকারী হিসেবে যুক্ত হলেন। অতঃপর সকালবেলা ৮টা-সাড়ে ৮টায় তল্লাশি ও নিরস্ত্রীকরণ অপারেশন শুরু হলো। তারিখ : ৩০ জানুয়ারি রোববার ১৯৭২ সাল।
 শহীদুল্লাহ কায়সার কোথায়?
আমার বন্ধু ওসমান হায়দার চৌধুরী নিজাম জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে কোনো একসময় থেকে রমনা রেসকোর্সে আমার সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। আরো অনেক বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়মে ও স্বাভাবিক প্রেক্ষাপটেই যোগাযোগ করতেন। একপর্যায়ে নিজাম বললেন যে, তার দুলাভাই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে নিখোঁজ। ওই তারিখে তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। তিনি কী জীবিত আছেন নাকি জীবিত নেই এটা কেউ বলতে পারছে না। স্বাভাবিক নিয়মেই পান্না কায়সার এবং আত্মীয়স্বজন সবার মন খারাপ। নিজাম বললেন, পান্না কায়সার মনে করছেন যে, শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুর এলাকায় বিহারিদের কব্জায় থাকতে পারেন। পান্না আপার মতে, মিরপুরে যদি কোনো প্রকার অনুসন্ধান বা খোঁজখবর বা তল্লাশি করা যায় তাহলে নিশ্চয়ই শহীদুল্লাহ কায়সারকে পাওয়া যাবে। ওসমান হায়দার আমাকে অনুরোধ করলেন, মিরপুরে খোঁজখবর নেয়ার জন্য সুযোগ-সুবিধা করে দিতে। ওসমান জানত যে, মিরপুর এখনো সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়নি বিধায়, সেখানে বেসামরিক বাঙালি নাগরিকদের যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ। অপর দিকে ওসমানের বড় বোন পান্না কায়সারের মনের ভেতরে যেকোনো কারণেই হোক না কেন দৃঢ়বিশ্বাস যে, মিরপুরে তল্লাশি করলেই শহীদুল্লাহ কায়সারকে জীবিত পাওয়া যাবে। এইরূপ পরিপ্রেক্ষিতে ওসমান আমার কাছে সাহায্য চাইল এই বলে যে, তুমি আমার বন্ধু, তুমি সেনাবাহিনীতে আছো, তুমি আমার দুলাভাইকে সন্ধান করতে সাহায্য করো। আমি উত্তর দিলাম যে, একলাভাবে তোমাদের কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারব না; তবে উপযুক্ত সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমি তোমাকে জানব।
সেনা সদস্যদের সঙ্গী জহির রায়হান
মিরপুরে অপারেশন করতে হবে এটা যখন চূড়ান্ত হয়ে গেল তখনই আমি ওসমানকে খবর দিলাম এবং বললাম যে, অপারেশন হবে, আমি আমার ওপরস্থ কর্মকর্তাকে অনুরোধ করব তোমাদের যেন তল্লাশির সুযোগ দেয়। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ শীতের কাকডাকা ভোরে একটা কার-এ করে ওসমানসহ তিন-চারজন আত্মীয়স্বজন রমনা রেসকোর্সে এসে উপস্থিত। রমনা রেসকোর্স মানে তখন নতুনভাবে নাম দেয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমার অফিসে আসার পর আমাদের একটি গাড়ি এবং উনাদের গাড়ি দু’টি গাড়ি নিয়ে মিরপুরে আমার অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর কাছে উপস্থিত হলাম। সবার সামনেই তার কাছে অনুরোধটি উপস্থাপন করলাম। তিনি বললেন, এতজন বেসামরিক নিরস্ত্র ব্যক্তিকে নিয়ে সামরিক অপারেশনে চলাচল করা মুশকিল এবং বেসামরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অতএব শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিবারের যেকোনো একজন মাত্র পুরুষ আত্মীয় আমাদের সাথে থাকতে পারে। আমরা যেখানে যেখানে তল্লাশি করব, সেখানে সেখানে তিনিও তল্লাশি করতে পারবেন। উপস্থিত শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিবারের আত্মীয়স্বজন সিদ্ধান্ত নিলেন ওই একজন মাত্র ব্যক্তি হবেন জহির রায়হান। এইরূপ পরিপ্রেক্ষিতেই তথা এইরূপ পরিস্থিতিতেই ওই দিন সকালবেলা জহির রায়হান দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির সাথে অপারেশনের সঙ্গী হয়েছিলেন। জহির রায়হানকে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে রেখে আমি, ওসমান ও অন্য সবাই যার যার জায়গায় ফিরে যাই। ওসমান কিছুক্ষণ পর আমার অফিসে এসে বসে থাকে এই উদ্দেশ্যে যে, মিরপুর থেকে কোনো খবর যদি ইবরাহিম পায় তাহলে ইবরাহিম থেকে খবরটা ওসমান তাড়াতাড়ি পাবে।
দুঃসংবাদে ভরা দিন
১৯৭২ সালের জানুয়ারির ওই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার এবং মিরপুরে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের মধ্যে কথা বলার মাধ্যম ছিল (প্রায়ই ডিসটার্বকারী) টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন লাইন এবং সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস সেট। ওই দিন দুপুর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর আসেনি; কারণ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিজেই মিরপুরে উপস্থিত। অতএব তিনি সরেজমিনে তাৎক্ষণিক সব খবর পাচ্ছেন। বিকেলবেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে যেই খবর এসে পৌঁছল সেই খবরটি স্বপ্নে-কল্পনায় এবং অনুমানে কোনো জন্মেই আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। মিরপুরের যুদ্ধে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার একজন জুনিয়র কমিশনড অফিসার এবং ৩৮ জন সৈনিক শহীদ হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। অফিসারের নাম সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কামরুল হাসান সেলিম; জুনিয়র কমিশনড অফিসারের নাম নায়েব সুবেদার মোমেন। এই শাহাদতপ্রাপ্ত সৈনিকদের সাথে আরেকজন শহীদ হলেন জহির রায়হান। অফিসারসহ মোট ৪০ জন সৈনিক এবং জহির রায়হানের কারো লাশ বা লাশের অংশবিশেষও ওই দিন আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এই দিনটি অন্যতম বিষাদময় দিন॥”
— “মিরপুর অপারেশন ১৯৭২ এবং জহির রায়হানের মৃত্যু প্রসঙ্গে” মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (অব:), বীর প্রতীক কর্তৃক উপস্থাপিত বক্তব্য / ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ইং
©কায় কাউস

মন্তব্যসমূহ